২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
নিবন্ধন করেও হজে যেতে পারছেন না ৭২৭ জন

অব্যবস্থাপনার মধ্যেই চলছে হজকার্যক্রম

অব্যবস্থাপনার মধ্যেই চলছে হজকার্যক্রম - ছবি : সংগৃহীত

বিগত বছরগুলোর মতোই চলতি হজ মওসুমে নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও হয়রানির ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। নির্ধারিত কোটা থাকার পরও এ বছর এক হাজারের বেশি হজযাত্রী সৌদি আরব যেতে পারছেন না। এর মধ্যে প্রাক-নিবন্ধন থাকলেও চূড়ান্ত নিবন্ধনই করেননি ৪০৯ জন। আর নিবন্ধন করার পরও ভিসা হয়নি ৭২৭ জনের। কয়েকটি বেসরকারি এজেন্সির অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে তাদের ভিসা হয়নি বলে জানা গেছে। যাত্রী সঙ্কটে এ পর্যন্ত ১৬টি হজ ফ্লাইট বাতিল করছে বিমান। আরো তিনটি ফ্লাইট বাতিল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

গত বছর হজের প্রাক-নিবন্ধন নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। পরে দফায় দফায় ফ্লাইট বিপর্যয় দেখা দেয়। এতে দুই শতাধিক হজযাত্রী শেষ পর্যন্ত হজে যেতে ব্যর্থ হন। তারা হজ ক্যাম্পে বিক্ষোভও করেন। এ বছর মোট এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজযাত্রীর কোটা পায় বাংলাদেশ। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় সাত হাজার ১৯৮ জন এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এক লাখ ২০ হাজার কোটা বণ্টন করা হয়। প্রাক-নিবন্ধন সারা বছর চালু থাকায় এ বছর সেটি নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু প্রাক-নিবন্ধিত থাকার পরও ৪০৯টি কোটা খালি থেকে যায়। সরকারি ব্যবস্থাপনায় ছয় হাজার ৭৯৮ জন নিবন্ধন করেন। কোটা খালি থেকে যায় চার শ’টি। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় নিবন্ধন করেন মোট এক লাখ ১৯ হাজার ৯৯১ জন। এ ক্ষেত্রে নয়টি কোটা খালি থেকে যায়। গত ১১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী এ বছরের হজকার্যক্রমে উদ্বোধন করেন। এরপর বিমান টিকিট বিক্রি ও ভিসার কার্যক্রম শুরু হয়। গত ১৪ জুলাই থেকে শুরু হয় হজ ফ্লাইট। বিমান বাংলাদেশ ও সাউদিয়া এয়ারলাইন্স যৌথভাবে হজ ফ্লাইট পরিচালনা করছে। কিন্তু ফ্লাইট শুরুর কিছু দিন পর থেকেই ফ্লাইট বিপর্যয় ঘটতে থাকে। গতকাল পর্যন্ত বিমান বাংলাদেশের মোট ১৬টি ফ্লাইট বাতিল করতে বাধ্য হয়। সর্বশেষ এক লাখ ২৬ হাজার ৬২ জনের ভিসা হলেও গতকাল পর্যন্ত টিকিট কেটেছেন এক লাখ ২৪ হাজার ৩৪০ জন। ফলে এখনো এক হাজার ৭২২টি টিকিট অবিক্রীত রয়েছে।

বিমান বাংলাদেশের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) শাকিল মেরাজ গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, টিকিট থাকার পরও পর্যাপ্ত যাত্রী না পাওয়ার কারণে তাদের একের পর এক ফ্লাইট বাতিল করতে হয়েছে। এখনো হাতে পর্যাপ্ত টিকিট রয়েছে। তার পরও আগামীতে আরো তিনটি ফ্লাইট বাতিলের আশঙ্কা রয়েছে।

হজ ফ্লাইট বাতিলের কারণ হিসেবে হজ এজেন্সিগুলো রিপ্লেসমেন্ট বেশি না দেয়ার অভিযোগ করেন। এ কারণে শেষ পর্যন্ত দুই দফা বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত রিপ্লেসমে›টের সুযোগ দেয় সরকার। তবে ধর্মসচিব আনিছুর রহমান অভিযোগ করেন, এজেন্সিগুলো অনেক ভুয়া হজযাত্রীর নিবন্ধন করেছে। এজন্য তারা রিপ্লেসমেন্ট করতে চাচ্ছে।

গত ৭ আগস্ট পর্যন্ত সৌদি দূতাবাস হজযাত্রীদের ভিসা দেয়ার শেষ সময় নির্ধারণ করে। কিন্তু দেখা যায়, তখনো পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার হজযাত্রীর ভিসার আবেদনই করা হয়নি। ফলে হজ অফিসের অনুরোধে আরো দুই দিন সময় বাড়ায় সৌদি দূতাবাস। কিন্তু তারপরও দেখা যায়, মোট এক লাখ ২৬ হাজার ৭৯৮ জনের মধ্যে সর্বশেষ ভিসা হয়েছে এক লাখ ২৬ হাজার ৬২ জনের। ৭২৭ জনের ভিসার আবেদনই করেনি বেসরকারি এজেন্সিগুলো।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এয়ার লাইফ ইন্টারন্যাশনাল, খাজা ট্রাভেলস, ইস্টার্ন ট্রাভেলসসহ কিছু এজেন্সির প্রতারণার শিকার এসব হজযাত্রী। নির্ধারিত সময়ে টাকা দিয়েও তারা সংশ্লিষ্ট এজেন্সির গাফিলতির কারণে এবার হজে যেতে পারছেন না। এদের মধ্যে অনেকে ভিসার জন্য আবেদন করলেও এজেন্সির অ্যাকাউন্টে প্রয়োজনীয় টাকা না থাকায় মেলেনি কাক্সিক্ষত ভিসা। এর মধ্যে প্রায় দেড় শ’ হজযাত্রীকে হজে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। বাকিদের চলতি বছর হজে যাওয়া অনেকটাই অনিশ্চিত বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

হজ অফিস সূত্র জানিয়েছে, মোট ৭২৭ জন হজযাত্রীর ভিসা ইস্যুর জন্য আবেদন করেনি সংশ্লিষ্ট এজেন্সি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য এয়ার লাইফ ইন্টারন্যাশনাল (লাইসেন্স নম্বর-৬০৩)-এর ৯১ জন, খাজা ট্রাভেলস (৮৮২)-এর ৪৯, ইস্টার্ন ট্রাভেলস (৫৫)-এর ১৯ জন, হক ইন্টারন্যাশনাল টুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস (৩৮৯) ও মাদার ট্রাভেলস ইন্টারন্যাশনাল (৯৬০)-এর ১৭ জন করে, ১৬ জন করে রয়েছে আদদীন ইন্টারন্যাশনাল (৩৬৬) ও কনওয়ে ট্রাভেলস অ্যান্ড টুরস (৫৬৯), শাহ মহসেন আওলিয়া নইমিয়া ট্রাভেলস ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড কাফেলা (১১৫০) ১৫ জন, এমবাসি ট্রাভেলস (৭৫৬) ১৪ জন, দারুল ইহসান হজ কাফেলা ট্রাভেলস অ্যান্ড টুরস (১৪৯৫) ১২ জন, আল মারসুস ইন্টারন্যাশনাল (৬৬৫) ও মোতালেব হজ সার্ভিস ১১ জন করে এবং ১০ জন করে রয়েছে রিলেশন ট্রাভেলস অ্যান্ড টুরস (১৩৮৩), সাবিক টুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস (১৩৮৪) ও সুলতানা ট্রাভেলস অ্যান্ড টুরস (১২৩০)। এ ছাড়া ৯ জন, ৮ জন ও ৭ জন থেকে শুরু করে একজন করেও রয়েছে বেশকিছু হজ এজেন্সির। এসব এজেন্সির বেশির ভাগ হজযাত্রীর ক্ষেত্রে ভিসার জন্য আবেদন পাঠানো হলেও সংশ্লিষ্ট এজেন্সির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকায় ফেরত পাঠানো হয়েছে। বিশেষ করে এয়ার লাইফ ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সির ৮৩ জনের ক্ষেত্রে এ সমস্যা দেখা দিয়েছে।

নাজমুল ইসলাম নামে একজন হজযাত্রী জানান, তিনি এবং তার বাবা অহিদুল ইসলাম হজে যাওয়ার জন্য এয়ার লাইফ ট্রাভেলসকে সব টাকা পরিশোধ করেছেন কিন্তু তাদের ভিসা ও বিমান টিকিট বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, তারাসহ আরো ৯১ হজযাত্রী এয়ার লাইফ ট্রাভেলসের প্রতারণার শিকার। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের বাসিন্দা মাহবুবুর রহমান জানান, তার বোন ও দুলাভাই হজে যাওয়ার জন্য সব টাকা মিনার ট্রাভেলসকে পরিশোধ করা সত্ত্বেও তারা ভিসা ও বিমান টিকিট হাতে পাননি।

রাজধানীর দক্ষিণখানের বাসিন্দা শাহজাহান জানান, তিনি হজে যাওয়ার সব টাকা পরিশোধ করার পরও বিভিন্নভাবে হয়রানির পর শনিবার তাকে জানানো হয়েছে ‘এ বছর তার হজে যাওয়া হবে না।’ খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন, মিনার ট্রাভেলস কাগজপত্রে তাকে গুরুতর অসুস্থ দেখিয়ে তার বদলে অন্য লোককে প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা করছে।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, হজ নীতিমালা অনুযায়ী ৪ শতাংশ প্রতিস্থাপনের বিপরীতে এজেন্সিগুলোর দাবির মুখে ১৫ শতাংশ দেয়া হয়েছে। তারপরও কেন এত হজ কোটা খালি থাকবে তা বোধগম্য নয়। এজেন্সিগুলো হজবানিজ্য করতে নামে-বেনামে নিবন্ধন করে রেখেছিল। সুযোগ বুঝে এসব কোটায় অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে হজে লোক পাঠিয়ে থাকে কোনো কোনো এজেন্সি। আবার কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে সুস্থ ব্যক্তিকে মৃত বা অসুস্থ বানিয়ে অন্যজনকে হজে পাঠায়। এগুলো তারই ফল।

এ প্রসঙ্গে হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) মহাসচিব এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম বলেন, কিছু কোটা প্রতি বছরই খালি থাকে। আমরা এই সংখ্যা শূন্যের ঘরে আনতে চাই এবং সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। প্রতিস্থাপনের নামে হজবানিজ্য আগামীতে থাকবে না বলেও মন্তব্য করেন হাব মহাসচিব। হাব থেকে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাবের সদস্যপদ বাতিল ছাড়া প্রতারক এজেন্সির ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতা সংগঠনের নেই। এ ব্যাপারে ধর্ম মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিতে পারে।

আগামী ২০ আগস্ট পবিত্র হজ পালিত হবে। গতকাল ৯টা পর্যন্ত ৩২৬টি ফ্লাইটে মোট এক লাখ ১১ হাজার ২৫৬ জন হজযাত্রী সৌদি আরবে গেছেন। আগামী ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ থেকে সর্বশেষ হজ ফ্লাইট পরিচালনা করা হবে। হজ শেষে ফিরতি ফ্লাইট শুরু হবে ২৭ আগস্ট থেকে।  

 


আরো সংবাদ



premium cement