২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

এরদোগান বিপুল ভোটে বিজয়ী তুরস্কের পার্লামেন্টেও এ কে পার্টির নেতৃত্বে পিপলস অ্যালায়েন্সের সংখ্যাগরিষ্ঠতা

তুরস্কের পার্লামেন্টেও এ কে পার্টির নেতৃত্বে পিপলস অ্যালায়েন্সের সংখ্যাগরিষ্ঠতা
-

তুরস্কের ঐতিহাসিক নির্বাচনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছেন। সর্বশেষ রাত ২টা ২০ মিনিট পর্যন্ত ৯৭ শতাংশ ভোট গণনায় প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী তিনি ৫২ দশমিক ৬ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টির প্রার্থী মুহাররেম ইনজে পেয়েছেন ৩৮ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট। অবশিষ্ট প্রার্থীরা বাকি ভোট পেয়েছেন।
হুররিয়াত ডেইলি আনাদোলু এজেন্সি, আলজাজিরা এবং বিবিসি এ খবর জানায়।
রোববার একই দিনে প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তুরস্কে।
সর্বশেষ ফলাফল অনুযায়ী পার্লামেন্ট নির্বাচনেও এরদোগানের একে পার্টির জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। তাদের প্রাপ্ত আসন সংখ্যা হলো ৩৪২।
অপর দিকে মোহাররেম ইনজের সমর্থক প্রধান বিরোধী দল সিএইচপি মোট ১৯২টি আসন পেয়েছে। রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম অনুযায়ী এবার নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন ৮৭ শতাংশ ভোটার।
তুরস্কে মতাসীন প্রেসিডেন্ট এরদোগান বিপুলভাবে জনপ্রিয় হলেও এবারই তাকে সবচেয়ে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হবে বলে বিশ্লেষকেরা বলছিলেন।
মি. ইনজের সাম্প্রতিক জনসভাগুলোয় ব্যাপক লোকসমাগম হওয়ায় সেই ধারণা জোরদার হয়েছিল। এরদোগান প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তুরস্কের সংবিধানে তিনি যে পরিবর্তন এনেছেন, তাতে প্রেসিডেন্টকে নতুন এবং ব্যাপক মতা দেয়া হয়েছে।এরদোগান ২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে ১১ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনের এ পর্যন্ত পাওয়া ফলাফল অনুযায়ী এককভাবে সর্বোচ্চসংখ্যক ভোট পেয়েছেন এরদোগান সমর্থকেরা।
৬০০ আসনের পার্লামেন্ট নির্বাচনে জিততে হলে একেপিকে ৩০০টির বেশি আসন নিশ্চিত করতে হবে। তবে নির্বাচনের পূর্ণাঙ্গ বা আনুষ্ঠানিক ফলাফল এখনো ঘোষণা করা না হলেও বেসরকারি ফলাফলের ভিত্তিতে এরই মধ্যে দেশ-বিদেশ থেকে অভিনন্দন বার্তা পেতে শুরু করেছেন এরদোগান। এরদোগানের দল একেপির নেতৃত্বাধীন ‘পিপলস অ্যালায়েন্স’ জোটে রয়েছে একে পার্টি, ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী দল এমএইচপি। অন্য দিকে ধর্মনিরপে মতবাদে বিশ্বাসী কামাল আতাতুর্কের দল সিএইচপির নেতৃত্বে ‘ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স’ জোটে রয়েছে ডানপন্থী ইয়ি পার্টি এবং ইসলামপন্থী দল সাদাত পার্টি। দুই শক্তিশালী জোটের কারণে এরদোয়ানের পিপলস অ্যালায়েন্সের নিরঙ্কুশ জয় কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করা হচ্ছিল।
একেপি’র প্রধান প্রতিপ সিএইচপি আধুনিক তুরস্কের স্থপতি মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের দল। ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তুরস্কের রণশীলরা দলটিকে অভিজাততন্ত্রের ধারক-বাহক হিসেবে দেখে এসেছে। অন্যদিকে কুর্দিরা দলটিকে দেখেছে বলপ্রয়োগকারী একনায়কতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে। কিন্তু এখন যারা এরদোয়ানের বিরোধিতা করছেন তারা সব বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পপাতী। তাদের প্রত্যাশা, এরদোয়ানবিরোধী ইসলামপন্থী ও কুর্দিদের এক করতে পারবেন মুহাররেম ইনজে।
এরদোয়ান এতকাল ধরে চলে আসা ধর্মনিরপে রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলামী মূল্যবোধকে শক্তিশালী করেছেন এবং তার সময়ে দেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামোতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। তবে নিজ সমর্থকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হলেও এরদোয়ানকে একনায়কও মনে করে তার বিরোধীরা।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, আধুনিক তুরস্কের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বিপুল মতা হাতে পাবেন তার শাসনকালের শুরু থেকেই। গণভোটে যে মতা প্রেসিডেন্টের হাতে তুলে দিয়েছেন তুরস্কের জনগণ তাতে ভাইস প্রেসিডেন্ট ও মন্ত্রিসভার পাশাপাশি বিচারক নিয়োগের একচ্ছত্র মতা পাবেন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। ফলে নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভবিষ্যৎ তুরস্ক গড়ে তোলার সুযোগ পাবেন তিনি।
তুরস্কের নির্বাচন কেন গুরুত্বপূর্ণ?
তুরস্কের অবস্থান এমন এক জায়গায় যে এর নেতা কে হচ্ছেন তার বৈশ্বিক গুরুত্ব আছে। কারণ দেশটির একদিকে ইউরোপ, অন্যদিকে ইরাক আর সিরিয়ার সীমান্ত। মুসলিম বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দেশ তুরস্ক পশ্চিমা বিশ্বেরও গুরুত্বপূর্ণ মিত্র, ন্যাটো জোটের সদস্য। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য পদপ্রার্থী। তুরস্কের সেনাবাহিনী ন্যাটো জোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাহিনী। জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েল দূতাবাস স্থাপন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনযজ্ঞের মতো মুসলমানদের জন্য স্পর্শকাতর ইস্যুগুলোতে বরাবরই আওয়াজ তুলেছেন এরদোয়ান। সৌদি জোটের কাতারবিরোধী অবরোধ প্রায় ব্যর্থ করে দেওয়ার পেছনে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। ওই অবরোধকে ইসলামবিরোধী পদপে বলে মনে করেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট। মূলত এরদোয়ান প্রশাসনের এমন নীতিগত অবস্থানের কারণেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশটির নির্বাচনকে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।
এই নির্বাচনকে রাজনৈতিক েেত্র ঐতিহাসিক হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। এই নির্বাচনের ফলাফলের উপর দেশটির ভবিষ্যত রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ভর করবে। প্রায় দেড় যুগ ধরে মতায় থাকা দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান ও তার দল একেপির জন্য এটিকে অগ্নি পরীা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
বিবিসি জানিয়েছে, দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান এখনো ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। তিনি চেয়েছিলেন, তার রাজনৈতিক বিরোধীরা যখন একটু অপ্রস্তুত অবস্থায় আছে তখনই নির্বাচন দিয়ে সহজে জিতে আসতে। কিন্তু হঠাৎ করেই নির্বাচনী প্রচারণার সময় এমন কতগুলো পরিবর্তনের আভাস দেখা দিয়েছে যা এরদোগানের নিশ্চিত বিজয় নিয়ে একটা সংশয় তৈরি করেছে বলেই বিশ্লেষকরা বলেছেন।
নির্বাচনী প্রচারের সময় দেখা গেছে, এরদোগানকে ঠেকাতে তার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো একজোট হয়েছে। মধ্য-বাম জোটের প্রার্থী মুহাররম ইঞ্জের জনসভায় এত বিপুল লোকসমাগম হয়েছে- যা আগে কখনো দেখা যায় নি। তাই মনে করা হয়, এরদোগান এই প্রথমবারের মতো এবার বেশ শক্ত নির্বাচনী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
তুরস্কের নির্বাচনে একই দিনে প্রেসিডেন্ট এবং পার্লামেন্ট নির্বাচন হয়েছে। নিয়ম হলো, যদি কোন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীই ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পান তাহলে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া দু'জনের মধ্যে দ্বিতীয় দফা ভোট গ্রহণ হবে ১৫ দিন পরে।
এরদোগানের হাতে ইতোমধ্যেই বিপুল মতা রয়েছে। এ নির্বাচনে জয়ী হলে তিনি আরো মতাধর হবেন। কারণ তিনি সংবিধানে যে সংস্কারের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন- তাতে প্রেসিডেন্ট পদটি আরো মতাশালী হবে আর তুলে দেয়া হবে প্রধানমন্ত্রী পদ। প্রেসিডেন্ট নিজে ডিক্রি জারি করতে পারবেন, মন্ত্রী ও বিচারপতি নিয়োগের মতা পাবেন। এই এজেন্ডার ওপরই এরদোগান ভোটারদের সমর্থন চাইছেন।
কিন্তু তার বিপরে মত হলো, এরদোগান একজন একনায়ক হয়ে উঠেছেন, বিচারবিভাগকে হাইজ্যাক করেছেন এবং পশ্চিমের সাথে তুরস্কের সম্পর্ককে ধ্বংস করেছেন। তাই এরদোগানকে ঠেকাতে বিরোধীদলগুলো নতুন করে একজোট হয়েছে এবার। তারা মনে করছেন, এ নির্বাচনে তাদের হাতে পরিবর্তনের সুযোগ এসেছে।


আরো সংবাদ



premium cement