২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

পানির দরে বিক্রি হবে ভূতের গ্রাম

স্পেনের উত্তরাঞ্চলের পরিত্যক্ত একটি ভুতুড়ে গ্রাম। গ্রামটিতে বাড়িঘর, জমাজমি থাকলেও নেই কোনো অধিবাসী - সংগৃহীত

জনসংখ্যা স্থানান্তরের ফলে শত শত ভুতুড়ে গ্রাম তৈরি হয়েছে। এসব গ্রামাঞ্চল থেকে বাসিন্দারা বাড়িঘর ফেলে অন্যত্র চলে গেছে। গোস্তভো ইগলেসিয়াসের মতো বহু লোক এসব গ্রামকে ভুতুড়ে গ্রাম বলে আখ্যায়িত করেছেন। উত্তর স্পেনের গ্যালিসিয়ার অঞ্চলের অ্যাকোরাডা পল্লীর আশপাশের অন্যদের মতো ইগলেসিয়াস কাজের জন্য বড় শহরে চলে যান। পেছনে ফেলে রেখে যান সতেজ উপত্যকাটিতে ছয়টি ধূসর পাথরের ঘর, দু’টি ঘোড়া ও একটি শস্যের গুদাম।

তার পরিবার কয়েক প্রজন্ম ধরে সেখানে বসবাস করত। তারা সেখানকার খেতে গম উৎপাদন করতেন ও গবাদিপশু পালন করতেন। কিন্তু প্রায় ৩০ বছর আগে তার বাবার মারা যায়। ফলে বাড়িটি খালি হয়ে গিয়েছিল, পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল। এখন গ্যালিশিয়ান উপকূলের একটি মাছ ধরার শহর বুরেলারের বন্দর পুলিশ হিসেবে কর্মরত ৫৭ বছর বয়সী একজন অন্য মালিকদের সাথে নিয়ে পল্লীটিকে বিক্রি করে এটিকে একটি নতুন জীবন দেয়ার চেষ্টা করছেন। মূল্য চাওয়া হয়েছে মাত্র ৮৫ হাজার ইউরো। ইগলেসিয়াস বলেন, ‘আমি চাই যে কেউ এটি কিনে নিক এবং এখানে ফের কর্মচাঞ্চল্য জীবনধারা অব্যাহত থাকুক।’ 
প্রধানমন্ত্রী পেদরো সানচেজের সরকার গত বছর ক্ষমতায় আসার সময় গ্রামীণ জনশূন্যতার বিপর্যয় রোধে মূল নীতিমালা তুলে ধরেছিলেন, এ ধরনের প্রচেষ্টা সঙ্কটাপন্ন অঞ্চলের গ্রামগুলোকে জনশূন্য হওয়া থেকে বাঁচাতে সাহায্য করতে পারে। এপ্রিল মাসে সাধারণ নির্বাচনের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন সানচেজ। গত শুক্রবার এই ধরণের বিপর্যয়ের প্রবণতা পরিবর্তনের ব্যবস্থা নিয়ে তিনি মন্ত্রিপরিষদে আলোচনা করেন। বিদেশি ক্রেতা ও উদ্যোক্তারা স্পেনের এ সমস্যার সমাধানে কাজ করতে শুরু করেছে। কারণ তারা কম দামে লাভজনক ভেবে কিছু পল্লী কিনে নিয়েছে। অ্যালদেয়াস আবান্দোনাদাস এই ধরনের বিক্রয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি অভিজ্ঞ জমি ক্রয়-বিক্রয় সংস্থা গত বছর ৪০টি গ্রাম বিক্রি করেছে। এসব গ্রামের ক্রেতাদের ৯০ ভাগই বিদেশী।

স্বল্প জন্মহার
অ্যালদেয়াস আবান্দোনাদাসের প্রতিষ্ঠাতা মিস এলভিরা ফাফিয়ান বলেছেন, স্পেনে প্রায় দেড় হাজার পরিত্যক্ত গ্রাম রয়েছে। সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণে মালিকদের না পেলে স্থানীয় পরিষদ তা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে। মালিকদের তত্ত্বাবধানে অপারগতার কারণে ক্রমবর্ধমান সংখ্যক সম্পত্তিরই রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারছে না স্থানীয় পরিষদ। তাই দিন দিন বাড়ছে ভুতুড়ে গ্রাম। এ প্রবণতা কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। 
ইউরোপের নগরায়নের কারণে পল্লীর মানুষের কর্মসংস্থান হওয়ায় উপমহাদেশের বৃহৎ এলাকাজুড়েই গ্রামাঞ্চল খালি হওয়ার প্রবণতা বিরাজ করছে। তবে স্পেনে এই প্রবণতা নাটকীয় রূপ ধারণ করেছে। দেশটিতে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটার ১২.৫ জন, যা পশ্চিম ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে কম।

স্পেনে এপ্রিলের নির্বাচনের প্রচারণায় খুব দ্রুতই জনশূন্যতা বড় ইস্যু হয়ে উঠেছে। বিরোধী দল সিদাদানাস পার্টি গত সপ্তাহে পৌরসভায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে আটজনেরও কম লোকের বাস যেসব স্থানে সেখানে কর কর্তনের প্রস্তাব করেছে। নতুন রাজনৈতিক দল পার্টিডো এনি শুরু থেকেই গ্রামীণ স্পেনের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে এবং জনশূন্যতার সঙ্কট প্রতিরোধে নীতি গ্রহণের জন্য চাপ দিচ্ছে। দলটি মে মাসে নির্ধারিত পৌর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পরিকল্পনা করছে।
২০১৭ সালে স্পেনের প্রজনন হার ছিল ১.৩ শতাংশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) সবচেয়ে কম জন্মহারের দেশগুলোর মধ্যে স্পেন ছিল দ্বিতীয়। মাল্টার পরই ছিল স্পেনের অবস্থান। শহরে ও গ্রামে জন্মহারের মধ্যকার পার্থক্য ইইউর দেশগুলোতে সর্বাধিক। তরুণদের অভাব মানেই জনসংখ্যার ঘাটতি পূরণ হচ্ছে না। এ অঞ্চলগুলো এমন উদ্যোক্তাদেরও হারিয়েছে যারা কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে চাঙ্গা করতে পারত।
সাম্প্রতিক ইউরোপীয় কমিশনের এক রিপোর্টে গ্রামীণ এলাকায় জনশূন্যতা এবং স্পেনের শহরগুলোর ওপর চাপের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। স্পেনের মাদ্রিদ, বার্সেলোনা ও ভূমধ্যসাগরের উপকূলে ছোট শহরগুলোতে বড় শহরগুলোর মতো এখনো দূষণ, যানজট ও অবকাঠামোর ওপর চাপ সৃষ্টির অবস্থা দেখা যায় না, তবে এসব শহরেও ভবিষ্যতে নিশ্চিত এসব সমস্য দেখা দেবে। মাদ্রিদে এক সাক্ষাৎকারে সরকারের গ্রামীণ জনশূন্যতাবিষয়ক কমিশনার মিসেস ইসাওরা লেয়াল বলেন, ‘অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন যে ২০৫০ সালের মধ্যে জনসংখ্যার ৭০ ভাগই বড় শহরে বাস করতে যাচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি যে এই বিপর্যয় মোকাবেলা করার ক্ষমতা আমাদের আছে। এখনো সময় আছে।’

সরকারি ও বেসরকারি খাত
ছোট ছোট অনেক পদক্ষেপ এরই মধ্যে চলছে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা বাড়ানোর মাধ্যমে মানুষের বাড়ি থেকেই কাজ করতে দেয়ার সুযোগ বাড়ায় বলে এক গবেষণায় দেখা যায়। গ্রামীণ এলাকায় ফেরানোর আরেকটি উপায় বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান। আস্তুরিয়াস ও গ্যালিসিয়াতে স্থানীয় সরকার ঐতিহ্যবাহী ঘরগুলোর সংস্কার ব্যয়ের আংশিক খরচ প্রদান করছে।
বেসরকারি খাতে বিজ্ঞাপন ও ফ্যাসন ফটোগ্রাফার আলবার্তো হিদালগো উত্তর স্পেনের বেশ কয়েকটি পরিত্যক্ত গ্রাম ফের বাসযোগ্য করতে অ্যালদেয়াস আবান্দোনাদাসের এক লাখ ২০ হাজার ইউরো দিয়ে কিনে নিয়েছেন। এ ছাড়া লোকজনকে গ্রামে ফেরাতে স্পেনের ঐতিহ্যের সাথে প্রযুক্তির সম্মিলনও ঘটানো হচ্ছে। 
সূত্র : ব্লুমবার্গ; ভাষান্তর : আনিসুর রহমান


আরো সংবাদ



premium cement