১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রাণীদের ভূমিকা

-

তারা ছিল বার্তা বাহক, গোয়েন্দা ও পাহরাদার। নেতৃত্ব দিয়েছে অশ্বারোহী বাহিনীর, সামনে থেকে বয়েছে রসদ। মৃত্যুও হয়েছে অগ্রে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘটনা। যাদের কথা বলা হচ্ছে তারা কোনো মানুষ নয়। তারা প্রাণী।

ঘোড়া, খচ্চর, কুকুর, কবুতর এমনকি বানরও ছিল এ দলে। দশক ধরে তারা ছিল যুদ্ধাস্ত্রের অংশ।

গবেষকরা প্রাণীদের এসব অবদান নিয়ে কমই ভেবেছেন। অফিসিয়ালি এর কোনো হিসাবও নেই। তবে এখন তাদেরকে সে বিশ্বযুদ্ধের নায়ক হিসেবে দেখা হচ্ছে। ফ্রান্স সম্প্রতি সে যুদ্ধের তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এবং ২০০৪ সালে ব্রিটেন লন্ডনের হাইড পার্কে নিহত এসব প্রাণীদের অনেক স্মৃতিচিহ্ন স্থাপন করেছে।

এখন দেখা যাক এসব চার পায়ের প্রাণী ও ডানাওয়ালা পাখিগুলো কিভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অবদান রেখেছে।

তারা কী করেছে?
এরিক বারাতায় নামক একজন ফরাসি ইতিহাসবিদ বলছেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এক কোটি ঘোড়া ও খচ্চর, এক লাখ কুকুর এবং দুই লাখের মতো কবুতরকে ব্যবহার করা হয়েছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মূলত শিল্পে উৎপাদিত যুদ্ধাস্ত্র- ট্যাংক, ট্রাক, যুদ্ধবিমান এবং মেশিন গান ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু আহতদের খুঁজে বের করার কাজে কুকুর, যুদ্ধাস্ত্র ও খাবার বহন, কবুতরের টেলিযোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার অথবা তাদের পালকে ছোট্ট ক্যামেরায় জার্মান অবস্থান শনাক্ত করার কাজে ব্যাপক ব্যবহার হয়েছে।

‘তারা ছিল সহ-যোদ্ধা’, বলছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর কম্পট্রোলার জেনারেল সার্জ বার্সেলিনি। তিনি লা সুভেনির ফ্রান্সিসেরও প্রধান। তিনি সম্প্রতি এক বক্তৃতায় যুদ্ধে পশুদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

বস্তুত, যুদ্ধক্ষেত্রের বিপজ্জনক ধোঁয়া থেকে বাঁচাতে এসব চারপায়ী যোদ্ধাদের মুখে গ্যাস মাক্স লাগানো থাকতো।

ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং অন্যান্য স্থানেও ঘোড়া ও খচ্চরের চাহিদাপত্র দেয়া হতো।

১৯১৪ সালে দক্ষিণ প্যারিসে একটি সাংকেতিক চিহ্নের মাধ্যমে অধিবাসীদের আদেশ দেয়া হয় যেন তারা তাদের ঘোড়া ও খচ্চরগুলো রিকিউজিশন কমিটির কাছে ১৪ নভেম্বরের মধ্যে জমা দেন। অথবা সামরিক কর্তৃপক্ষের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। তখন এটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল যে, সেখানে যুদ্ধের তাড়াতাড়ি সমাপ্তি ঘটছে না, বলবৎ থাকতে পারে আরো চার বছর।

পালকযোদ্ধারা
১৯১৮ সালে দক্ষিণ ফ্রান্সে ‘হারিয়ে যাওয়া’ একটি ব্যাটালিয়নের ১৯৪ জন মার্কিন সৈন্যকে বাঁচিয়েছিল কবুতরের একটি দল। এসব কবুতরকে নাম দেয়া হয়েছিল চের আমি বা ডিয়ার ফ্রেন্ড।

জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া ৫৫০ জনের একটি বহরে হামলা চালাতে গিয়েছিল মার্কিন সৈন্যরা। তারা জানতো না যে এরা শত্রু বাহিনী নয়।

অক্টোবরের ৪ তারিখ মেজর চার্লিজ হুইটলেসি চের আমিকে মার্কিন ব্যাটালিয়নের অবস্থান লক্ষ্য করে আকাশে ওড়ান একটি চূড়ান্ত আবেদন দিয়ে যে, ‘বিধাতার দোহাই, এটা বন্ধ কর’।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শতবার্ষিকী কমিশনের তথ্যমতে, জার্মান বাহিনীর গুলিতে চের আমি একটি চোখ এবং একটি পা হারালেও উড়া থামায়নি। আধা ঘণ্টা সময়ে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয় সে। পরে ‘হারিয়ে যাওয়া ব্যাটালিয়নের’ সদস্যরা চার দিন পর মার্কিন লাইনে ফেরত আসে।

ফরাসি আর্মির আরেকটি বার্তা বাহক কবুতর ছিল ভেইল্যান্ট। এ যুদ্ধে তারও ব্যাপক অবদান রয়েছে।

১৯১৬ সালের ৪ জুন একে আকাশে উড়ানো হয়েছিল একটি কড়া বার্তা দিয়ে যে, ‘এটি আমার শেষ কবুতর’।

ফরাসি কমান্ডার সিলভেইন ইউজেনে রায়নাল তার বাহিনীর লোকদের বাঁচাতে ভেইল্যান্টকে ব্যবহার করেছিলেন। ধূর্ত পাখিটি বিষাক্ত গ্যাস ও ধোয়ার মধ্য দিয়ে উড়ে গন্তব্যে পৌঁছেছিলেন।

চের আমি ও ভেইল্যান্টকে ফ্রান্সের ক্রোইক্স ডি গুয়েরে বা ওয়ার ক্রস পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছিল।

ঘোড়া
ঘোড়া প্রাচীন যোদ্ধা। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যেসব ঘোড়া ব্যবহৃত হয়েছিল তাদের অধিকাংশই আগে থেকে তৈরি করা ছিল না। যে কারণে তাদের লাখো মারা গিয়েছিল বিভিন্ন রোগ, অবসাদ ও শত্রুর গুলিতে।

আমেরিকান যুদ্ধ স্মৃতিসৌধ কমিশনের তথ্য মতে, ১৯১৭ সালে নৌকায় করে পাঁচ লাখেরও বেশি ঘোড়া ও খচ্চর ইউরোপে আনা হয়েছিল। তখন এটা বড় ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

১৯১৫ সালে ম্যাগাজিন দ্য সান্তা ফি ম্যাগাজিনের এক নিবন্ধে লেখা হয়েছিল, এ ব্যবসা কৃষক, কন্ট্রাক্টর, সরবরাহকারী ও রেলপথের জন্য উপকারী হয়েছিল, কিন্তু ভালো ছিল না পশুগুলোর জন্য।

বাইরে থেকে আনা প্রাণীদের পরিষেবা
বাইরে থেকে আনা প্রাণীদের মধ্যে জ্যাকি নামে একটি বানর বেশ সেবা দিয়েছিল। সে তৎকালীন ব্রিটিশ অধ্যুষিত মিসরে প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকান পদাতিক ব্রিগেডের সাথে ছিল এবং পরবর্তীতে কাজ করেছে ফ্রান্স ও বেলজিয়ামে। তার প্রখর শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি শত্রু সৈন্যদের অবস্থান শনাক্তে অথবা সম্ভাব্য আক্রমণের ব্যাপারে জানতে বেশ কাজে লেগেছিল।

১৯১৮ সালের এপ্রিলে যখন দক্ষিণ আফ্রিকান সৈন্যরা ব্যাপক গোলাগুলির মুখোমুখি হন তখন জ্যাকি আক্রান্ত হয়েছিল। তার আহত পা কেটে ফেলতে হয়েছিল।

যুদ্ধের কুকুর
মানুষের ভালো বন্ধু হিসেবে এ কুকুরগুলো সৈন্যদের বেশ সহায়তা করেছিল। এসব কুকুর প্রথমত শত্রুদের অবস্থান শনাক্ত ও আহতদের শনাক্তে কাজ করেছে। তারা পদাধিক বাহিনী, বার্তা বাহক, বিভিন্ন জিনিসপত্র বাহক ও ইঁদুর শিকারী হিসেবে কাজ করেছে। পরিখায় উকুন ও মাছির আক্রমণ থেকে বাঁচতেও এরা সাহায্য করেছে। ফরাসি মিলিটারি ১৯১৫ সালের ডিসেম্বরে কুকুরদের নিয়ে এ সেবার ব্যবস্থা করে।

তারা অফিসিয়াল কেউ ছিল না কিন্তু তারা ছিল সৈন্যদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সৈন্যদের মনোবল সৃষ্টিতে এসব প্রাণীর বিশেষ ভূমিকা ছিল।

এসব কুকুর ও অন্য প্রাণীগুলো সৈন্যদের এ বিষয়টি বুঝতে সাহায্য করেছিল যে, ‘জীবন সম্পর্কে ভাবো... এবং যে জীবন নিয়ে ভাবতে তা আবার খুঁজো’, বলছিলেন ফরাসি ইতিহাসবিদ বারাতায়। গত মাসে প্যারিসে এক বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন।

যুদ্ধফেরত এসব কুকুরগুলোকে ব্রিটিশ পাইলটরা সাথী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।


আরো সংবাদ



premium cement