১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

উপজেলায় আ’লীগের প্রার্থী নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম

উপজেলায় আ’লীগের প্রার্থী নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম
উপজেলায় আ’লীগের প্রার্থী নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম - ফাইল ছবি

চাঁদপুর সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে মাত্র একজনের নাম প্রস্তাব করে কেন্দ্রে সুপারিশ পাঠিয়েছে জেলা আওয়ামী লীগ। আবার পার্শ্ববর্তী জেলা লক্ষ্মীপুর সদরে ৯ জনের নাম সুপারিশ করেছেন ওই জেলার নেতারা। তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ তিনজনের নাম প্রস্তাব করে কেন্দ্রে তালিকা পাঠানোর নির্দেশনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত একেক জেলা থেকে একেক সংখ্যক নাম পাঠানো হয়েছে কেন্দ্রে।

এসব নাম পাঠানো নিয়ে আবার বিস্তর অভিযোগও জমা পড়েছে কেন্দ্রে। কোথাও কোথাও স্থানীয় এমপি আবার কোথাও জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও আর্থিক লেনদেনের এ অভিযোগ দেয়া হয়। এমন প্রেক্ষাপটে শেষ পর্যন্ত তৃণমূল থেকে পাঠানো নামের বাইরে সবার জন্যই দলের মনোনয়ন ফরম উন্মুক্ত করে দেয় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী বাছাইয়ে কেন্দ্রের বেঁধে দেয়া নিয়ম/পদ্ধতি না মানার অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন এলাকার আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে। আবার কোনো কোনো জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধেও অভিযোগ করেছেন দলটির তৃণমূল নেতারা।

যাতে বলা হচ্ছে, নিয়ম অনুসরণ না করায় মনোনয়নপ্রত্যাশী হলেও নিজের উপজেলা থেকে কেন্দ্রে পাঠানো তালিকায় নাম ওঠানো সম্ভব হয়নি। এ জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্যকে দায়ী করে অভিযোগপত্র জমা দিয়ে যাচ্ছেন ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ের দফতরে। যাতে লেখা রয়েছে, কেন্দ্রের নির্দেশনা না মেনে ক্ষেত্রবিশেষে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে অথবা স্থানীয় সংসদ সদস্য ক্ষমতার জোর দেখিয়ে তৃণমূল থেকে তার আস্থাভাজন লোকের নাম কেন্দ্রে পাঠাচ্ছেন। ফলে প্রকৃত রাজনৈতিক, সংগঠক-নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়ছেন। কোথাও কোথাও আবার পাঠানো নামের সিরিয়াল নিয়েও ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এসব নিয়ে কেন্দ্রে অভিযোগের শেষ নেই।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও তৃণমূলের একাধিক সূত্র জানায়, সম্প্রতি লক্ষ্মীপুর সদর থেকে পাঠানো নামের সিরিয়াল নিয়ে মঙ্গলবার দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এর সাথে দেখা করে জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে অর্থ দাবির অভিযোগ করেছেন লক্ষ্মীপুর পৌর মেয়র আবু তাহের।

তিনি বলেন, ‘সিরিয়ালের এক নম্বরে তার ছেলে ও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান সালাহউদ্দিন টিপুর নাম দিতে বিপুল অঙ্কের টাকা দাবি করেন জেলার দুই শীর্ষ নেতা। টাকা না দেয়ায় টিপুর সিরিয়াল দুই নম্বরে দেয়া হয়।’

এ ঘটনা জানাজানির পরদিনই ভোরে উপজেলা চেয়ারম্যান মনোনয়নপ্রত্যাশী ছয়জন ও ভাইস চেয়ারম্যান মনোনয়নপ্রত্যাশীসহ অর্ধশতাধিক নেতা ওবায়দুল কাদেরের সাথে দেখা করে এর প্রতিবাদ জানান। জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পক্ষ নিয়ে তারা বলেন, ‘তালিকায় নাম উঠানো বা সিরিয়ালের জন্য টাকা দাবির ঘটনা সম্পূর্ণ বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। কারো সাথেই এমন ঘটনা ঘটেনি। বরং প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে যেতে কখনো কখনো আর্থিক প্রলোভন আবার কখনো কখনো নানা হুমকিও প্রদান করছে তাহের পরিবার।’ এ ব্যাপারে ওবায়দুল কাদেরের জোরালো হস্তক্ষেপ কামনা করেন নেতারা।

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মিয়া মোহাম্মদ গোলাম ফারুক পিংকু নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘সদর উপজেলা থেকে একক প্রার্থী পাঠানোর ব্যাপারে আমাদের ওপর নানা চাপ ছিল। কিন্তু আমরা তা না করে দলের ত্যাগী ও দুর্দিনের পোড় খাওয়া নেতাদের নামও কেন্দ্রে পাঠাই। এতে একটি মহল ক্ষুব্ধ হয়ে আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। কেন্দ্র চাইলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারে। আমরা প্রস্তুত। তবে কেন্দ্রের কাছে আমাদের অনুরোধ, যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের যাতে মূল্যায়ন করা হয়।’

জেলা সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নূরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ অস্বীকার করে একইভাবে বলেন, ‘আর্থিক লেনদেনের প্রশ্নই আসে না। তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে আমরা যোগ্য সব মনোনয়নপ্রত্যাশীর নাম পাঠিয়েছি। এখন কেন্দ্রই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিবে। আমরা আশা করি যোগ্য প্রার্থীকেই কেন্দ্র মূল্যায়ন করবে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানানয়, তৃণমূল নেতারা ঢাকায় এসে সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের হাতেও এসব অভিযোগপত্র পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছেন। আবার কখনো কখনো দলের সাধারণ সম্পাদকের কাছেও সরাসরি অভিযোগ জানান।

গত দুই তিন দিনে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে তৃণমূল নেতাদের এমন নানা অভিযোগের স্তূপ জমা পড়েছে। দলের দফতর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ ও অফিস সহকারীরা এসব অভিযোগ জমা নিচ্ছেন তৃণমূল নেতাদের কাছ থেকে। কার্যালয়ের একজন অফিস সহকারী জানান, এখন পর্যন্ত অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়েছে। তার সঠিক হিসাব নেই। দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহের চেয়ে অভিযোগপত্র জমাও কম নয় বলে জানান তিনি।

অভিযোগপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, স্থানীয় সংসদ সদস্যদের ‘আস্থাভাজন’ হতে না পারায় তৃণমূল থেকে পাঠানো তালিকায় নাম ওঠাতে সক্ষম হননি তারা। কিন্তু যাদের নাম পাঠানো হয়েছে, তাদের থেকে এগিয়ে রয়েছেন ওই নেতারা। এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্র থেকে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সুবিচার পাওয়ার আশা করছেন তৃণমূলের ওই নেতারা।

তাদের অভিযোগপত্রে আরো লেখা রয়েছে, বর্ধিত সভা ও ভোটাভুটির মাধ্যমে অনধিক তিনজনের নাম কেন্দ্রে পাঠাতে বলা আছে। অথচ স্থানীয় সংসদ সদস্যের নির্দেশে বর্ধিত সভা বা ভোটাভুটি কিছুই না করে তার পছন্দের ব্যক্তির নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, নাম পাঠানো নিয়ে তৃণমূল থেকে নানা অভিযোগ এসেছে। প্রাথমিক তদন্তে অনেক ক্ষেত্রেই এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। এমন প্রেক্ষাপটে পাঠানো নামের বাইরেও সবার জন্য মনোনয়ন ফরম বিক্রি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। যাতে যোগ্য নেতারা কেউ বাদ না পড়েন। এখন কেন্দ্র চাইলে যে কাউকেই মনোনয়ন দিতে পারবে। আর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধেও তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তৃণমূল নেতাদের অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, দলের দফতরে তৃণমূল নেতারা বিভিন্ন উপজেলা থেকে অভিযোগপত্র জমা দিয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে দেখা করেও অভিযোগ জানাচ্ছেন। অভিযোগের সত্যতা থাকলে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর তৃণমূল থেকে নাম না এলেও সমস্যা নেই। সবার জন্য মনোনয়ন ফরম উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। যোগ্যতা থাকলে অবশ্যই বিবেচনায় নেয়া হবে।


আরো সংবাদ



premium cement