২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভোট নিয়ে আ’লীগের দু’গ্রুপের দ্বন্দ্ব : সংখ্যালঘুদের উপর হামলা

- ছবি : সংগৃহীত

ফরিদপুরের সদরপুর ও ভাঙ্গা উপজেলায় নির্বাচন পরবতী সহিংসতায় অনেকেই এলাকা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। ওই এলাকায় সংখ্যালঘু হিন্দুদের টার্গেট করে হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অর্ধশতেরও বেশি বাড়ি-ঘরে হামলার অভিযোগ পাওয় গেলেও পুলিশ মামলা নিয়েছে ৭টি। আর হামলাকারীদের কয়েকজনকে আটক করা হলেও অধিকাংশই ধরা-ছোঁয়ার বাইর।

ফরিদপুর-৪ আসনটি ভাঙ্গা, সদপুরের একাংশ এবং চর ভদ্রাসন নিয়ে গঠিত। নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরী। তিনি ২০১৪ সালেও স্বতন্ত্র হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের কাজী জাফর উল্যাহ নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে হেরে যান। নিক্সন স্বতন্ত্র নির্বাচন করলেও তিনি আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারক পর্যায়ের এক নেতার ভাগ্নে। কাজী জাফর উল্যাহ ২০১৪ সালেও নৌকা প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী নিক্সন চৌধুরীর কাছে পরাজিত হন।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের দিন রাতেই হামলা শুরু হয়। এরপর সোমবার ও মঙ্গলবার হামলা অব্যাহত থাকে। সংখ্যালঘু হিন্দুদের কমপক্ষে ৩০টি বাড়ি-ঘরে হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। হামলার পর অনেকেই ভয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। ওইসব এলাকায় পুলিশ টহল বাড়ানো হয়েছে। রবিবার রাতে হামলার পর কয়েকটি এলাকায় সেনাসদস্যরাও টহল দেন বলে জানা গেছে।

গত মঙ্গলবার নৌকা প্রতীকের কাজী জাফর উল্যাহ এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছেন, ‘‘নির্বাচনের দিন রাতে ও পরদিন ভাঙ্গায় অন্তত ৮৬টি জায়গায় হামলা হয়েছে। বাড়িঘর দোকানপাট ভাঙচুর করা হয়েছে। আমরা এ ব্যাপারে থানায় ৪৮টি অভিযোগ দিয়েছি, কিন্তু পুলিশ মাত্র ৭টি মামলা নিয়েছে।’’

ভাঙ্গা উপজেলার কাউলিবেড়া ইউনিয়নের খাটসা গ্রামের গোপাল মন্ডলের বাড়িতে হামলা হয় ৩০ ডিসেম্বর ভোটের দিন রাতেই। হামলার পর তিনি তার স্ত্রী ও দুই সন্তান ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। অজ্ঞাত স্থান থেকে তিনি টেলিফোনে বলেন, ‘‘ভোটের দিন রাত সাড়ে ৭টা-৮টার দিকে স্বতন্ত্র প্রার্থীর লোকজন আমাদের গ্রামে হামলা চালায়। তারা ৩-৪শ' হবে। তাদের হাতে ধারলো অস্ত্র ছিল। আমরা নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়েছি, এটাই আমাদের অপরাধ। তারা আমার বাড়ি-ঘর ভাঙচুর করে। টাকা এবং মূল্যবান সামগ্রী লুট করে নিয়ে যায়। আমার দাদুর গলায় রামদা ধরে। তাকে মারপিট করে। এখন বাড়িতে আমার মা-দাদু আছেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আমি পালিয়ে আছি।’’

তিনি আরো জানান, ‘‘ওই রাতে আমাদের ইউনিয়নের আরো ২০-২৫টি বাড়িতে হামলা হয়। কিন্তু তারা এখন কেমন আছেন আমি জানি না। আমি তো এলাকায় নেই।’’

একই উপজেলার নাসিরাবাদ ইউনিয়নের ভদ্রকান্দা গ্রামের বাসুদেব সরকার ৩০ ডিসেম্বর রাতের হামলার বর্ণনা দেন ডয়চে ভেলের কাছে। তিনিও হামলার পর এলাকা ছেড়েছেন ভয়ে। তিনি জানান, ‘‘আমাদের এলাকার সেন্টারে নৌকা প্রতীক কম ভোট পায়। স্বতন্ত্র বেশি পায়। আমরা ভোট গণনা শেষে বড়ি চলে যাই। এরপর রাতেই হামলা হয়। আমি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সেক্রেটারি। আমার কাকা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা। তাই আমাদের বাড়িটিই তারা টার্গেট করে। রাত সাড়ে ৮ টার দিকে হামলা হয়। আমাদের যৌথ পরিবার। ১৭ জন সদস্য। তিনটি ঘর। তিনটি ঘরই ভাঙচুর ও লুটপাট করে।’’ তিনি আরো জানান, ‘‘আশপাশের কয়েকটি বাড়িতেও হামলা হয়।’’

হামলার বিষয়ে কথা বলার জন্য কাজী জাফর উল্যাহকে ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। আর নিক্সন চৌধুরীর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তবে নিক্সন চৌধুরীর সমর্থক বলে পরিচিত কাউলিবেড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম বলেন, ‘‘হামলা দু'পক্ষই করেছে। হিন্দুদের বাড়ি-ঘরেও হামলা হয়েছে। নৌকা যেহেতু পরাজিত হয়েছে তাই তাদের ওপর হামলা বেশি হয়েছে।’’

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘আমি নিক্সন চৌধুরীর লোক হলেও হামলায় জড়িত নই। হামলার সঙ্গে ছন্নছাড়া ধরনের লোকরা জড়িত।’’

ফরিদপুর জেলার পুলিশ সুপার জাকির হোসেন এই হামলার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘‘নির্বাচনের দিন রাতে ছাড়াও পরের দিনও হামলা হয়েছে। এখানে দুইপক্ষই কমবেশি হামলায় জড়িত। আমরা এরই মধ্যে ৭টি মামলা নিয়েছি। আরো মামলা হবে। এ পর্যন্ত আমরা ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছি।’’

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘এখন এলাকার পরিস্থিতি শান্ত আছে। যেসব এলাকায় হামলা হয়েছে, সেখানে পুলিশ পাহারা আছে। সড়কে টহল বাড়িয়েছি।’’

এদিকে ফরিদপুরসহ নির্বাচন পরবর্তী হামলা ও সহিংসতার তদন্ত করবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন৷ হামলার বিষয়ে কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড, মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এবার নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা কম হলেও একটি মানুষের ওপর হামলা হলেও তা গ্রহণযোগ্য নয়৷ নির্বাচনের আগে ও পরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার এই ঘটনা স্থায়ীভাবে বন্ধের ব্যবস্থা নিতে হবে৷ আর যাদের আটক করা হয়েছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে৷ জড়িত কেউই যাতে পার না পায়৷ আর ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপুরণ দিতে হবে সরকারিভাবে৷''


আরো সংবাদ



premium cement