২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নির্বাচন নিয়ে ইকোনমিকস টাইমসের বিশ্লেষণ

- ফাইল ছবি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল বিশ্বের একটি সফল স্টোরি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল বলে মনে করা হচ্ছিল। গত বছর দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রায় আট শতাংশের কাছাকাছি ছিল, যা প্রতিবেশী ভারতের চেয়ে বেশি। আর দেশটির মানব উন্নয়নের সূচক নোবেল বিজয়ী অমৃত সেনের দৃষ্টিতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচকের চেয়েও অধিক। 

বিশ্বের গুটিকয়েক দেশ তাদের জাতীয় পরিচিতির সাথে সেকুলারিজমকে সফলভাবে প্রয়োগ করেছে তার একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ মিয়ানমারে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসা ৭ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিয়েছে যা সত্যিকারার্থে অনেক বড় ও ধনী দেশকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে।

তাই গত সপ্তাহের নির্বাচনে শেখ হাসিনার দলের জয় মোটেই বিস্ময়ের বিষয় ছিল না। তবে তিনি যে বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন তা কোনোভাবে বিশ্বাসযোগ্য নয়। তার দল আওয়ামী লীগ ২৯৮ আসনের নির্বাচনে ১০টি বাদে সব আসনে জয়ী হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে পেয়েছেন ২২৯৫৩৯ ভোট আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছেন ১২৩ ভোট।

তাই নির্বাচনকে ‘কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা’ জন্য তার দলের বিরুদ্ধে নম্রভাষার অভিযোগ আনলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। দীর্ঘ সময় ধরে এই নির্বাচনের আয়োজন করা হয়েছে যাতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ভীতিপ্রদর্শন, জেল বা নির্বাচনে ভোটদানে বাধাদানসহ সব কিছুই করা হয়েছে। বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া জেলে রয়েছেন। তার ছেলে ও দৃশ্যত উত্তরাধিকারী ব্রিটেনে রয়েছেন এবং দেশে ফিরলে তাকে যাবজ্জীবন জেলে থাকতে হবে।

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গের মতোই রাজনৈতিক সহিংসতা দীর্ঘ দিন ধরেই বাংলাদেশের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হয়ে আছে। গত বছর পশ্চিমবঙ্গ এসব কারণে বেশ রক্তাক্ত হয়েছিল। সবচেয়ে খারাপ যে বিষয়টি তা হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যেই অপরাধী রয়ে গেছে, যারা পুনর্নির্বাচনের প্রচারণায় শেখ হাসিনার হয়ে কাজ করেছেন। দেশটিতে কিছু স্বাধীন প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা গণতন্ত্রের ওপর এ ধরনের বর্বরতার ওপর নজরদারি করতে পারত। কিন্তু সেখানের বর্তমান বিচার ব্যবস্থা পুরোপুরি আওয়ামী লীগের সহানুভূতিশীলদের দ্বারা পূর্ণ। 

এ দিকে নির্বাচন নিয়ে যেসব সাংবাদিক প্রশ্ন তুলেছেন, তাদের গ্রেফতার করতে সরকার নতুন একটি বিতর্কিত আইনের আশ্রয় নিয়েছে।

তারপরও নির্বাচনের সময় যেসব ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডের কারণে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে অথবা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখেছে যে, তাদের ভোট ইতোমধ্যে দেয়া হয়ে গেছে, তাদের কাহিনীতে ভরপুর হয়ে আছে ফেসবুকের টাইমলাইন। 

ভারত থেকে যা দেখা গেছে, যে পদ্ধতিতে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা খুবই হতাশাজনক। কারণ প্রথমত, বাংলাদেশকে এখানে দীর্ঘকাল ধরে একটি রোল মডেল হিসেবে গণ্য করা হয়েছে শাসনের দিক দিয়ে। অর্থাৎ এমন একটি দেশ যা ভারতের থেকে ব্যতিক্রমে একটি জোরদার রফতানি খাত গড়ে তুলেছে, এমন একটি দেশ যা প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব সত্ত্বেও জনগণকে বিশেষ করে নারীদের ক্ষমতায়ন করেছে এবং এমন একটি দেশ যেখানে তৃণমূলে উন্নয়নের প্রশ্নে পরীক্ষা নিরীক্ষায় রাষ্ট্রযন্ত্র নমনীয় ও বাস্তব ভূমিকা পালন করেছে। 

আর যে পরিচয়ের ওপর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অর্থাৎ মুসলিম নয়, বাঙালি মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক ইসলামের ব্যাপারে আপসহীন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে স্বয়ং শেখ হাসিনা সেই ধরনের অংশীদার, ভারত যা পেতে পছন্দ করে। নিশ্চয়ই ২০০০ সালের দিকে খালেদা জিয়ার সময়কালকে নয়াদিল্লিতে স্মরণ করা হয় একটি কম্পন হিসেবে। কেননা বাংলাদেশকে তখন মনে হয়েছিল রক্ষণশীলতার দিকে মোড় নিতে যা পাকিস্তানের ভাগ্যকে সুপ্রসন্ন করেছিল এবং তা প্রতিবেশী দেশে সন্ত্রাসবাদ রফতানিকারকে পরিণত হয়েছিল। 

কিন্তু সরকারের নির্বাচন কর্তৃপক্ষ যে ক্ষতি করল, তা ভারতের সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সাথে মোটেই মানানসই নয়। এই মেয়াদে খুব কমসংখ্যক সরকার শেখ হাসিনার পুনর্নির্বাচনকে উপভোগ করবে। একটি অনুদার গণতন্ত্র দীর্ঘ মেয়াদে খুব কম ক্ষতিকর নয়। কেননা তা পরিচালিত হয় একটি উদার মহলের দ্বারা। 

একটি সরল সত্য হলো শেখ হাসিনা চিরকাল শাসন করবেন না। কেউ পারে না। আর যদি তার কর্তৃত্বপরায়ণতার দিকে মোড়ও শেষ হয়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশীদের মন থেকে আওয়ামী লীগের সেকুলার জাতীয়তাবাদ ও বহুত্ববাদ নীতি সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া হবে সত্যিই দুঃখজনক। আর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থিতিশীলতায় এর প্রভাব পড়বে আরো খারাপ।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উচিত এই পাঁচ বছর মেয়াদকে তার শেষ মেয়াদ মনে করা এবং তিনি যখন শেষ পর্যন্ত বিরোধী দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন, তখন কী ঘটবে সে ব্যাপারে পরিকল্পনা নিতে শুরু করা। প্রত্যেক গণতান্ত্রিক নেতাকে যথাসময়ে এটাই অবশ্যই করতে হয়। তার প্রশাসন যেসব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে, তার উচিত এগুলোর পুনর্নির্মাণ শুরু করা।


আরো সংবাদ



premium cement