২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সরকার নির্বাচন কমিশনকে গিলে ফেলেছে : রিজভী

সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন রিজভী। - ছবি: নয়া দিগন্ত

ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) গিলে ফেলেছে এবং আত্মা বিক্রির শর্তেই কতিপয় নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ইসি নেপথ্য লোকের বার্তানুযায়ী কাজ করছে বলেই ঝাঁকে ঝাঁকে ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় চোখ বন্ধ করে রাখে। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ নেই বলেই এখন পর্যন্ত তাদের কোনো কাজ তারিফযোগ্য হয়নি। আইন, আদালত ও প্রশাসনকে সম্পূর্ণরুপে গ্রাস করার পরে কব্জার মধ্যে থাকা নির্বাচন কমিশনকে একেবারে গিলে ফেলেছে সরকার। এখন নোংরাভাবে ইসিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। কারণ ইসির কতিপয় কর্মকর্তা সেই সুযোগ করে দিয়েছে। 

আজ সোমবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে রিজভী এসব কথা বলেন। নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনে দলের কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ, মো: শরীফুল আলম, মুহাম্মদ আব্দুল আউয়াল খান, শাহীন শওকত প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

‘রিজভী কখনো হাসেন না’ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা হাছান মাহমুদের এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় রিজভী বলেন, ‘আমি তো ক্রীতদাসের হাসি হাসতে পারি না। আমার চারপাশে প্রতিনিয়ত জুলুম করে অন্যায়ভাবে সহকর্মী সতীর্থদের ধরে নিয়ে যাবেন। গুম,খুন করবেন আর আমি হাসবো! সেই ক্রীতদাসের হাসি আমি হাসতে পারিনা।

লিখিত বক্তব্যে রুহুল কবির রিজভী বলেন, পুলিশের বেপরোয়া আচরণ ও হয়রানিতে আবারো ‘ফেনী মার্কা’ নির্বাচনের আলামত পাওয়া যাচ্ছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে মামলা ও গ্রেফতার পাহাড়ী ঢলের মতো ধেয়ে চলেছে দেশব্যাপী। গতকালও ঢাকা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, ঝিনাইদহ, ফেনি, কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মীকে বিনা মামলায়, বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশ। পুলিশ কর্তৃক প্রিজাইডিং অফিসারদের নাম চাওয়া, বিএনপির কোনো লোক নির্বাচনী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছে কি না ইত্যাদি তদারকি করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যরা। সারাদেশে নির্বাচনী কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়ার জন্য পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশ তালিকা তৈরি করছে। স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষকদের মধ্যে কারা কারা সরকার দলের সমর্থক, কারা বিরোধী দলের সমর্থক তাদের তালিকা করছে তারা। এমনকি বিরোধী মতের সমর্থক হলে তাদের নির্বাচনী কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা হচ্ছে বা তাদের হুমকি দিয়ে বলা হচ্ছে আপনারা নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবেন না। গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে মোবাইলেও তাদেরকে হুমকি দিচ্ছে। পুলিশের প্রকাশ্য ও গোপন হুমকিতে এ নিয়ে দেশজুড়ে শিক্ষকদের মধ্যে আতংক বিরাজ করছে।

তিনি বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর সীমাহীন জুলুমের পরও এখন দিনরাত বাড়িতে বাড়িতে হানা দিয়ে তল্লাশীর নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রহরায় সারাদেশকে দাসশিবিরে পরিণত করা হয়েছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়িতে না পেয়ে পরিবারের সদস্যদের উপরও হামলা করছে, মারধর করছে, কিংবা পরিবারের সদস্যদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটারদের হাবুডুবু খাওয়াতেই নির্বাচনী মাঠ জনশুন্য করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি দেউলিয়া হয়ে গেছে বলেই আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনাচারে লিপ্ত হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করে রিজভী বলেন, নির্বাচন কমিশন পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে। এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সকল কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছে সরকার। শুধু তাই নয় প্রশাসনকেও নিয়ন্ত্রণ করছে সরকার কঠোরভাবে। দেশজুড়ে এখনো গায়েবি মামলা, গ্রেফতার, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে হানা দিয়ে নিপীড়ণ অব্যাহত রয়েছে আগের মতোই। একজন নির্বাচন কমিশনার আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ও প্রশাসনকে ইসির অধীনে নেয়ার প্রস্তাব করলেও সিইসি ও কতিপয় কমিশনার তা আপত্তি জানান। মূলত সরকারের হুকুম তামিল করতেই ব্যস্ত রয়েছে নির্বাচন কমিশন। ইসির কর্মকর্তারা ও আওয়ামী নেতারা এখন কথা বলছেন একই সুরে। বেশ কিছুদিন আগে সিইসি বলেছিলেন-বাংলাদেশে শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, গত দুদিন আগে আরেকজন কমিশনার বললেন অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে না। গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন ‘পৃথিবীর কোনো দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না, বাংলাদেশেও শতভাগ স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচন হবে না।’ আসন্ন নির্বাচন নিয়ে তাদের বক্তব্য এক আশঙ্কাজনক অশনি সংকেত। সিইসি ও ইসির বক্তব্য মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অনিয়ম ও ভোট ডাকাতিতে উৎসাহিত করবে। তারা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য শপথ নিয়েছেন, কিন্তু নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে তারা শপথ ভঙ্গ করেছেন। যে বক্তব্যটি অবৈধ শাসকগোষ্ঠীকেই উৎসাহ যোগাবে।

বিএনপির শীর্ষ এই নেতা বলেন, বিটিভিসহ বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনকে চাপ প্রয়োগ করে আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছে। বিটিভি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান হলেও নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরও আওয়ামী লীগের পক্ষে একচেটিয়া প্রচারণা চালানো হচ্ছে। গতকাল একটি বেসরকারি টেলিভিশনে নির্বাচনি জনমত জরিপের নামে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে কৃত্রিমভাবে জনমত বেশি দেখিয়ে প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে। যা সুস্পষ্ট আচরণ বিধি লঙ্ঘনই নয়, ক্ষমতাসীনদের পক্ষে নগ্ন দালালির নামান্তর মাত্র। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভিসহ বেসরকারি টেলিভিশনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কোনো চিহ্নই নেই, তফসীল ঘোষণার পরও রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভিসহ কতিপয় বেসরকারী টেলিভিশন নির্লজ্জ মোসাহেবী করছে সরকারী দলের পক্ষে। আমি অবিলম্বে সকল টেলিভিশনকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের ব্যবস্থা নিতে ইসির প্রতি আহবান জানাচ্ছি।

তফসিল ঘোষণার পর সারাদেশে গ্রেফতারের চিত্র তুলে ধরে রিজভী বলেন, ঢাকা মহানগরীর শাহজাহানপুর থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সোহাগ ভূঁইয়াকে গোয়েন্দা পুলিশ কর্তৃক আটকের পর এখনো অস্বীকার করা হচ্ছে। সোহাগকে ধরতে গিয়ে তার বোন সেলিনাকে আটক করা হয়। পরে সোহাগকে আটকের পর তার বোনকে ছেড়ে দেয়া হয়। গোয়েন্দা পুলিশ এখনো স্বীকার করছে না। তাকে যে ডিবি কার্যালয়ে নেয়া হয়েছে সে ব্যাপারে তার পরিবার নিশ্চিত। কেনো তাকে আটকের বিষয়টি স্বীকার করছে না পুলিশ তা গভীর আতঙ্ক ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। আমি অবিলম্বে সোহাগ ভূঁইয়াকে জনসমক্ষে হাজির করে তার পরিবারের নিকট ফিরিয়ে দেয়ার জন্য জোর দাবী জানাচ্ছি। এছাড়া বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস এর বাড়ির সামনে থেকে রাকিব সহ ১৫ জন বিএনপি নেতাকর্মীকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। আটককৃত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পূর্বে কোনো মামলা নেই। যশোর-৬ নির্বাচনী এলাকার অন্যতম মনোনয়ন প্রত্যাশী আবু বক্কর আবুকে গতরাতে রাজধানীর বিজয়নগর এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তার স্বজনরা সম্ভাব্য সকল স্থানে খোঁজ করার পরও তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাকে আইনশৃৃঙ্খলা বাহিনীই আটক করেছে। আমি অবিলম্বে আবু বক্কর আবুকে জনসমক্ষে হাজির করার জোর দাবি জানাচ্ছি। ঢাকার শ্যামপুর থানা বিএনপি সভাপতি আ ন ম সাইফুল ইসলামের বাসায় পুলিশী তল্লাশীর নামে আসবাবপত্র ভাংচুর এবং বাসার লোকজনদেরকে বাসা ছেড়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। তার ম্যানেজার মিলনকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। সাইফুল ইসলামের মাকে ধমক দিয়ে ডিবি পুলিশ বলে গেছে-আপনার ছেলেকে না পেলে আপনাকে নিয়ে যাব। বাসার তালা ভেঙ্গে বেডরুমে প্রবেশ করে সিন্দুক ভেঙ্গে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির দলিলপত্রসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র নিয়ে যায় তারা। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনায় আমি তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং অবিলম্বে সাইফুল ইসলামের বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া দলিলপত্র ফেরত দেয়ার জোর দাবি করছি। পাশাপাশি সকল ধরণের অন্যায় অপকর্ম থেকে সরে আসার জন্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আহবান জানাচ্ছি।

তিনি বলেন, ফেনীর যুবদল নেতা আতিকুর রহমান মামুন, ছাত্রদলের মেজবাহ উদ্দিন ভূঁইয়া, জেলা যুবদলের আল ইমরান, জিয়াউদ্দিন পাটোয়ারী, স্বেচ্ছাসেবক দলের হাসান মাহমুদ সবুজ, ছাত্রদলের মোশারফ হোসেন, ইভু পাটোয়ারী, আমজাদ হোসেন সুমন এবং আবু তালেব ভুঁয়াসহ ৩০/৩৫ জন নেতাকর্মী মিথ্যা ও বানোয়াট মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে গেলে তাদের জামিন বাতিল করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। গাজীপুর মহানগর বিএনপির খান জাহিদুল ইসলাম ও তাপসকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। পুবাইল থেকে বিএনপি নেতা সোহাগ ও দেলোয়ারসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে। চাঁদপুরের মতলবে বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়ীতে-বাড়ীতে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে লুটপাট করে এবং লুদুয়া বাজারে দোকানপাটে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর করে।
তিনি বলেন, কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক এবং কিশোরগঞ্জ-৬ আসনের বিএনপির মনোনয়ন প্রার্থী শরীফুল আলমের পক্ষে গতকাল কিশোরগঞ্জের ভৈরবে বিএনপির শান্তিপূর্ণ উঠোন বৈঠক চলাকালে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর যুবলীগ ও ছাত্রলীগ দেশীয় অস্ত্রসহ সন্ত্রাসী হামলা চালায়। এসময় সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন অস্ত্র দিয়ে আঘাত করার মাধ্যমে বিএনপির কমপক্ষে ১২ জন নেতাকর্মীকে গুরুতর আহত করে। সন্ত্রাসীরা বিএনপির নেতাকর্মীদের ঠিকাদারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়, ভেনিস বাংলা চাইনিজ রেস্টুরেন্টসহ আরো পাঁচটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও লুটপাট করে। যে বাড়িতে বৈঠক হচ্ছিল সে বাড়ি ঘরও ভাংচুর করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। এখন বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে উল্টো মামলা করছে পুলিশ।
রিজভী আরো বলেন, এছাড়া কুলিয়ারচরে ওসমানপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি শহীদুল্লার বাড়িতে পুলিশ হামলা করে তাকে না পেয়ে তার ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে আঘাত করে মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করে। এ সময় বিএনপি নেতা শহীদুল্লার ছেলেকে ধরে নিয়ে আসে। আমি এই কাপুরুষোচিত ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং অবিলম্বে সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জোর দাবি করছি। একই সঙ্গে আটকৃতদের মুক্তি দাবি করছি।

দেখুন:

আরো সংবাদ



premium cement