১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

ছাত্রলীগ সভাপতি-সম্পাদকের কক্ষেই চলে রাতভর নির্যাতন

- ছবি : সংগৃহীত

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) শাখা ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের নির্যাতন থেকে বাদ পড়েনা নিজ দলীয় নেতাকর্মীরাও। নেতাদের দ্বি-মতে কিংবা অন্য কোন গ্রুপের হলেই তাকে মেরে হল থেকে বের করে দেওয়াসহ ক্যাম্পাসে আসতেও বাধ্যবাধকতা করে দেওয়া হয়।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর করা হয় শিবির কিংবা ছাত্রদল আখ্যা দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি আবাসিক হলে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সাধারণ সম্পাদকের কক্ষসহ প্রায় তেরটি কক্ষ ব্যবহৃত হয় নির্যাতনের জন্য। হলগুলোর এসব কক্ষে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন সাধারণ শিক্ষার্থীসহ দলীয় নেতাকর্মীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি ছাত্র হল ও একটি ছাত্রী হলের প্রতিটিতেই রয়েছে ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ এবং নির্যাতনের জন্য নির্দিষ্ট কয়েকটি কক্ষ। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলের ৩০০১, ৫০০৩, ৩০৩, ৫০১, ৫০২, কাজী নজরুল ইসলাম হলের ৪০১, ৪০৬, ৫০৫, ৫০৬, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ২০৮, ৩০৫, নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধূরানী হলের ৫১০, ১১৩ নং কক্ষ দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রিত এবং এই কক্ষগুলোতে চলে নির্যাতন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে উঠতে হলে শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগের হয়েই ‘গণরুমে’ উঠতে হয়। কেউ কেউ বিশেষ ক্ষমতাবলে হলে উঠেই সিঙ্গেল সিট পেয়ে যায়। হলের জুনিয়র শিক্ষার্থীদের মাঝে মাঝে হলের টিভি রুমে অথবা হলের সিনিয়র নেতাদের রুমে ডেকে নেওয়া হয়। যেখানে চলে ম্যানার শেখানোর ও র‌্যাগের নামে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। কেউ কেউ এসব সহ্য করেও হলে থেকে যায় আবার কেউ হল ছেড়ে পাড়ি জমায় মেসে।

হলের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, নেতাদের রুমে ডেকে তাদের আচরণ শেখানোর নামে চলে নির্যাতন। কেউ ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে যেতে না পারলে তাকে সম্মুখীন হতে হয় হাজারো জবাদিহিতার। এমনকি কোন কোন সময় হলগুলোর প্রধান ফটকে তালা দিয়ে শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য করা হয়।

অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের গণরুম-গেস্টরুম প্রথা চালু থাকলেও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটু ভিন্নতা রয়েছে। গণরুম-গেস্টরুম কেন্দ্রিক নির্যাতন না চলে এ নির্যাতন চলে রাজনৈতিক কক্ষগুলোতে এবং পার্টি অফিসে।

এমনকি বিভিন্ন স্থানে বসে ছাত্রলীগের বিচারের বৈঠক। সেখানে পেটানো হয় দলীয় নেতাকর্মীদের এমনকি সাধারণ শিক্ষার্থীরাও বাদ যায় না এ নির্যাতন থেকে। এছাড়াও রয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর করে ছাত্রদল-শিবির বানিয়ে চালিয়ে দেওয়ার ঘটনা। শুধু তাই নয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর করে মোবাইল, টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা রয়েছে বেশ কয়েকটি। ছাত্রলীগের নির্যাতনে হল ছাড়তে বাধ্য হয়েছে শতাধিক শিক্ষার্থী। একাডেমিক পড়াশুনায়ও প্রভাব পড়েছে অনেকের।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সভাপতির কক্ষে (৩০০১) নিয়ে শাসানো হয় এমনকি মাঝে মাঝে বিচারের নামে মানসিক ও শারিরিক নির্যাতন করা হয়। নিজ গ্রুপের বাহিরে গিয়ে কথা বললেই তার জন্য মারধর অবধারিত।

২০১৭ সালের ১৬ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মহিউদ্দিন নাবিল, ছাত্রলীগ নেতা জসিম উদ্দিন ও জয়নাল আহমেদকে সভাপতির কক্ষে ডেকে নিয়ে সারারাত নির্যাতন চালানো হয়। জসিম উদ্দিনকে বৈদ্যুতিক শক এবং অন্যদের লাঠি, তার, রড দিয়ে পেটায় সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ, সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম মাজেদ, ছাত্রলীগ নেতা হাসান বিদ্যুত, শাখা ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতাসহ ১০/১৫ জন।

শুধু এ ঘটনাই নয় বিভিন্ন সময়ে নেতা-কর্মীদের বিচারের নামে নির্যাতন করা হয় তার কক্ষে। মারধরের শিকার হওয়া ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মহিউদ্দিন নাবিল বলেন, ‘শাখা ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করার পরে আমরা সভাপতির কক্ষে গেলে আমাদের উপর রাতভর অমানসিক নির্যাতন চালানো হয়। পরে ঐ দিনই ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হই।’

শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম মাজেদের কক্ষে (৩০১) চলে শিবির-ছাত্রদল নিধন নামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে মারধর করা এবং তাদের সাথে থাকা টাকা ও মেবাইল ছিনতাই করা। এছাড়া বহিরাগত সন্ত্রাসীদের নিয়ে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

২০১৭ সালের ৫ জুন ক্যাম্পাস থেকে সাধারণ সম্পাদক মাজেদের কক্ষে ডেকে নিয়ে যায় মামুন চৌধুরী (গণিত ৭ম ব্যাচ) ও পরিসংখ্যান ৮ম ব্যাচের এক শিক্ষার্থীকে। পরে তাদেরকে বেধড়ক মারধর করে সাধারণ সম্পাদক মাজেদসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী। বিষয়টি অনেকে জেনে গেলে তাদেরকে শিবির সন্দেহে মারধর করেছে বলে প্রচার করা হয়।

শুধু এ ঘটনাই নয় বিভিন্ন সময়ে সাধারণ শিক্ষার্থীসহ দলীয় নেতাকর্মীরাও তার হাতে মারধরের শিকার হয়েছে। এছাড়াও শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলে ৫০০৩, ৩০৩, ৫০১, ৫০২ নং কক্ষগুলোতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দ্বারা সাধারণ শিক্ষার্থীসহ দলীয় নেতাকর্মীরা মারধর ও র‌্যাগিংয়ের শিকার হয় নিয়মিত।

কাজী নজরুল ইসলাম হলের ৪০১, ৫০৫ ও ৫০৬ নং কক্ষে ডেকে নিয়ে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করার অভিযোগ রয়েছে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম হল শাখা ছাত্রলীগের গ্রন্থনা ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক তারেকুল ইসলামকে হলের ৫০৬ নং কক্ষে ডেকে নিয়ে মারধর করে ছাত্রলীগ নেতা ও ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ১০ম ব্যাচের শিক্ষার্থী ইমন, রাশেদ ও শিশির।

এর আগে ২০১৭ সালে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ১০ম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফয়সাল হাসানকে হলটির ৫০৫ নং কক্ষে ডেকে নিয়ে মারধর করে রাইহান ওরফে জিসান, জয় বড়ুয়া , শাহ আমানুল্লাহ্ পরানসহ কয়েকজন। ২০১৬ সালে লোকপ্রশাসন বিভাগের ৮ম ব্যাচের শিক্ষার্থী তানভীর তমালকে ৪০১ নং কক্ষে ডেকে মারধর করে হাত ভেঙ্গে দেয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক স্বজন বরণ বিশ্বাস, সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম দস্তগীর ফরহাদ ও কাজী নজরুল ইসলাম হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক সাইফুল ইসলাম সাদি। শুধু তাই নয় এ হলের বেশ কয়েকটি কক্ষেই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দ্বারা মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় দলীয় নেতা-কর্মীসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

২০১৭ সালের ১৭ জুলাই বঙ্গবন্ধু হলের ৩০৫ নং কক্ষে নিয়ে মারধর করা হয় ছাত্রলীগ নেতা কাউসার আহমেদকে। তাকে ঐ কক্ষে নিয়ে লাইট বন্ধ করে বেধড়ক পেটানো হয়। এছাড়াও হলটির ২০৮ নং কক্ষেও শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হতো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ছাত্রী হল নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধূরাণী হলটির কোন শিক্ষার্থী হলের ছাত্রলীগ নেতাদের কথা না মানলে তাদেরকে হলের নেতাদের কক্ষে ডেকে শাসানোসহ মারধর করা হয়।

এ বছরের জানুয়ারিতে হলের ডাইনিং ম্যানেজার লিপি আক্তারকে ৫১০ নং কক্ষে নিয়ে উচ্চ শব্দে গান বাজিয়ে মারধর করে শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আইভি রহমান, ছাত্রলীগ নেতা ইসরাত জাহান জেরিন, অপর্ণা নাথ, আশা আফরীনসহ কয়েকজন।

এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের টিভি রুম ও ছাত্রলীগ নেতাদের কক্ষে নিয়ে ছাত্রীদের শাসানো হয়। এমনকি অনেককে হল থেকে বের করে দেওয়ারও হুমকি দেওয়া হয়। এছাড়া ১১৩ নং কক্ষে এবং হলের টিভি রুমে নিয়মিত ছাত্রীদের ডেকে নিয়ে শাসান আইভি রহমানসহ হলের নেতৃবৃন্দ।

শুধু এ ঘটনাগুলোই নেই প্রতিনিয়তই আবাসিক হলগুলোতে মানসিক ও শারিরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এমনকি হলগুলোতে প্রত্যেক কক্ষে কক্ষে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মোবাইল অনুষন্ধান করার অভিযোগ রয়েছে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। বিষয়গুলো প্রশাসনের নজরে আসলেও বার বার এগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে ছাত্রলীগের আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও হল প্রশাসন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শাখা ছাত্রলীগের নেতাদের উপর ক্ষোভ প্রকাশ করে ভুক্তভোগী বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা বলেন, ‘দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ছাত্রলীগ করে মার খেয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে আসাটা শুধু কষ্টেরই নয় বরং লজ্জার। তাদের মতো করে এমন হিংস্র মনোভাব নিয়ে রাজনীতি করা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের জন্য কলঙ্কের।’

নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও শাখা ছাত্রলীগের এমন কর্মকাণ্ডের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম মাজেদ বলেন, ‘যারা সংগঠন বিরোধী কাজ করেছে তাদেরকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগই শাস্তি দিয়েছে। আমার বিরুদ্ধে মারধরের বিষয়ে অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং বিরোধীদের চক্রান্ত। আমার কক্ষে কাউকে কখনও মারধর করা হয়নি। যদি কেউ এমন অভিযোগের প্রমাণ দিতে পারে তাহলে আমি ছাত্রলীগ থেকে অব্যহতি নেব।’

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ বলেন, ‘কারণ ব্যতীত কখনও কাউকে মারা হয়নি। সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেই।’

তার কক্ষে বিভিন্ন সময়ে নেতাকর্মীদের বিচার করার বিষয়টি স্বীকার করলেও আটকে রেখে নির্যাতন করার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর কাজী মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, ‘যখনই কোন মারধরের ঘটনা ঘটেছে আমরা বিষয়টি সর্বোচ্চ আমলে নিয়ে উভয় পক্ষকে নিয়ে বসে সমাধানের চেষ্টা করেছি। এখানে কোন দলকে প্রাধান্য দেয়া হয়নি।’


আরো সংবাদ



premium cement