২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

পরীক্ষা ও ডামি ক্লাসের বিধান রেখে নীতিমালা চূড়ান্ত

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) - ছবি : সংগৃহীত

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে অভিন্ন ও সমন্বিত নীতিমালা চূড়ান্ত করেছে উচ্চশিক্ষার মাননিয়ন্ত্রক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। নিয়োগের আগে অবশ্যই প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষা, ডামি ক্লাস এবং মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হতে হবে। ইউজিসি প্রণীত এ নীতিমালা খসড়া এখন চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে। সহসাই এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে নীতিমালার খসড়া নিয়ে বৈঠক হবে। অনুমোদন পেলেই তা কার্যকর করতে প্রজ্ঞাপন বা আদেশ জারি করা হবে। মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। 

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহিদুল্লাহ অভিন্ন শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালার বিষয়টি নিশ্চিত করে গতকাল বলেছেন, উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন হচ্ছে অহরহ। উচ্চশিক্ষার মান বজায় রাখতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একই মানে উন্নীতকরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে অভিন্ন নীতিমালা কার্যকর হলে শিক্ষার মান উন্নত হবে। শিক্ষকদের মধ্যে পদোন্নতি বৈষম্যও দূর হবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষের ইচ্ছেমতো নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। যা কোনো অবস্থায় কাম্য নয়। অনেক ক্ষেত্রে যোগ্য ও মেধাবী প্রার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন, ভিসি বা প্রো-ভিসির পছন্দের লোকজন শিক্ষক পদে নিয়োগ পাচ্ছেন। এতে করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনামও ক্ষুণœ হচ্ছে। যোগ্যতার ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা বা নীতিমালা না থাকায় এ নিয়ে এক ধরনের বৈষম্য বিরাজ করছে। তিনি বলেন, উচ্চশিক্ষার সমমান নিশ্চিত করতে এসব বিষয় গুরুত্ব দিয়ে একটি অভিন্ন ও সমন্বিত শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নীতিমালা বা নির্দেশনা জারি হলে বাধ্য হয়েই সবাইকে এর আওতায় আসতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

অভিন্ন নীতিমালার খসড়ায় বলা হয়েছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য অনার্স ও মাস্টার্স উভয় স্তরে আলাদাভাবে সিজিপিএ ৩ দশমিক ৫ পয়েন্ট থাকতে হবে। বর্তমানে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি ও প্রো-ভিসিদের পছন্দের প্রার্থীরাই এ পদে নিয়োগ পাচ্ছেন। আগে মেধাবীদের প্রাধান্য দেয়া হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেটাকেও বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। 
নীতিমালায় বলা হয়েছে, বর্তমানে থিসিসসহ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেতে ন্যূনতম ১০ বছরসহ মোট ২২ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এমফিল প্রার্থীর ক্ষেত্রে সাত বছরসহ মোট ১৭ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় থাকতে হবে। পিএইচডিধারীদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতাসহ ন্যূনতম ১২ বছর সক্রিয় শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।

সহকারী থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতিতে একজন শিক্ষককে কমপক্ষে সাত বছর ক্লাসরুম শিক্ষকতাসহ ১৪ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। থিসিসসহ এমফিল প্রার্থীর ক্ষেত্রে ন্যূনতম ছয় বছরসহ ৯ বছর সক্রিয় শিক্ষকতায় থাকতে হবে। পিএইচডিধারীদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম চার বছরসহ মোট সাত বছর শিক্ষকতা করতে হবে।
সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেতে একজন শিক্ষককে ন্যূনতম তিন বছরের সক্রিয় শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। থিসিসসহ এমফিলধারীদের জন্য দুই বছর এবং পিএইচডি থাকলে এক বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। একই সাথে স্বীকৃত কোনো জার্নালে অন্তত চারটি প্রকাশনা থাকতে হবে।
এ ছাড়া বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, কলা, মানবিক, বিজনেস স্টাডিজ, চারুকলা ও আইন অনুষদভুক্ত বিষয়গুলোর জন্য প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক, সহকারী থেকে সহযোগী এবং সহযোগী থেকে অধ্যাপক পদে নিয়োগের জন্য একটি অভিন্ন শর্তাবলি যোগ করা হয়েছে নীতিমালায়। একইভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং, আর্কিটেকচার, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিষয়, মেডিসিন ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা আলাদা শর্তযুক্ত হয়েছে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে নীতিমালায় বলা হয়েছে, গ্রেড-৩ থেকে গ্রেড-২-এ উন্নীত হতে হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য থেকে অধ্যাপক পদে অন্তত চার বছর চাকরি এবং স্বীকৃত কোনো জার্নালে বিষয়ভিত্তিক দু’টি নতুন আর্টিকেল প্রকাশের শর্তজুড়ে দেয়া হয়েছে। একইভাবে দ্বিতীয় গ্রেডপ্রাপ্ত অধ্যাপকদের মোট চাকরিকাল অন্তত ২০ বছর এবং দ্বিতীয় গ্রেডের সর্বশেষ সীমায় পৌঁছানোর দুই বছর পর জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রথম গ্রেড দেয়ার শর্ত দেয়া হয়েছে। তবে এ সংখ্যা মোট অধ্যাপকের ১৫ শতাংশের বেশি হবে না। 
নতুন নীতিমালায়, প্রার্থীর পরীক্ষার ফল প্রকাশ অপেক্ষমাণ থাকার সময়ে আবেদন গ্রহণযোগ্য হবে না। এমফিল ও পিএইচডিধারীদের অতিরিক্ত যোগ্যতা বলে বিবেচনা করা হলেও তাদের জন্য নিয়োগের অন্যান্য শর্ত কোনোভাবে শিথিল করা হবে না।

ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা প্রণয়নে প্রথম এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। ২০০২ ও ২০০৪ সালে অভিন্ন নিয়োগ নীতিমালার খসড়াও চূড়ান্ত হয়। পরে ২০০৬ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আরো একবার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষক সমিতিসহ রাজনৈতিক চাপের কারণে কোনো নীতিমালা ও প্রস্তাবনা আলোর মুখ দেখেনি।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নেতারা জানান, ২০১৫ সালে জাতীয় বেতন স্কেলে বৈষম্যের প্রতিবাদে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলনের এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে শিক্ষক নেতাদের বৈঠক হয়। বৈঠকে তারা নিয়োগ ও পদোন্নতির বৈষম্য তুলে ধরেন। তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে একটি মানসম্মত অভিন্ন নীতিমালা করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ইউজিসিকে নীতিমালার খসড়া তৈরির দায়িত্ব দেয়। মন্ত্রণালয় ও মঞ্জুরি কমিশন এ নীতিমালা চূড়ান্ত করতে একাধিক কর্মশালার আয়োজন করে। দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ সংশ্লিষ্টরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা কার্যকর হলে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে শিক্ষকদের গবেষণার প্রবণতা বাড়বে এবং মানসম্পন্ন শিক্ষার পরিবেশ উন্নত হবে। শিক্ষক নিয়োগে বাণিজ্য, রাজনৈতিক দৌরাত্ম্য, পদোন্নতি জটিলতা, লেজুড়ভিত্তিক শিক্ষক রাজনীতির প্রভাব কমাসহ শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা আসবে।


আরো সংবাদ



premium cement