২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পাঠ্যবইয়ে উপেক্ষিত সাধারণ ও দুর্বল শিক্ষার্থীরা

পাঠ্যবইয়ে উপেক্ষিত সাধারণ ও দুর্বল শিক্ষার্থীরা - সংগৃহীত

প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যবই রচনা, বইয়ের বিষয় ও সংখ্যা নির্বাচনের ক্ষেত্রে সাধারণ ও দুর্বল শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনায় নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ শিক্ষক ও অভিভাবকদের। 

পাঠ্যবই নিয়ে আলোচনার সময় অনেক অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, মনে হয় দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে রচনা করা হয়েছে পাঠ্যবই। এ অভিযোগের পক্ষে বিভিন্ন শ্রেণীর গণিত বই এবং কঠিন গণিতের কথা তুলে ধরলেন তারা। 

নাজমুন আরা নামে রাজধানীর কাজীপাড়ার একজন অভিভাবক বলেন, আমার মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। প্রাইমারি থেকে এ পর্যন্ত তার যে পাঠ্যবই তা আমি ভালো করে দেখেছি। যখন পঞ্চম শ্রেণীতে গণিত বই হাতে নেই তখন মনে হয় তাকে পঞ্চম শ্রেণীতেই গণিত বিশেষজ্ঞ বানানো হবে। আবার যখন ইংরেজি বই হাতে নেই তখন মনে হয় তাকে এক ক্লাসেই ইংরেজি ভাষা পুরোপুরি শিখতে হবে। এভাবে প্রতিটি বই দেখলে মনে হয় তাকে ওই বিষয়ে এক ক্লাসেই বিশেষজ্ঞ বানিয়ে ছাড়বে। বছরে একটি বাচ্চা পড়ালেখা করে বড়জোর ৯ থেকে ১০ মাস। কারণ অনেক স্কুলে নভেম্বর মাসেই ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়। আর জানুয়ারিতে অনেক স্কুলে ক্লাসই শুরু হয় না ঠিকমতো। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণীতে পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা ১৪টি। তাহলে গড়ে একটি বই পড়ার জন্য তো ২০ দিনও সময় পায় না একজন শিক্ষার্থী। তাহলে পঞ্চম, ষষ্ঠ শ্রেণীতে গণিতের মতো কঠিন একটি বই কিভাবে একজন শিক্ষার্থী মাত্র এক মাস বা তার চেয়েও কম সময়ে আয়ত্ত করবে। এভাবে ব্যাকরণসহ ইংরেজি বই কিভাবে একজন শিক্ষার্থী এক মাসে শেষ করে ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করবে। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণীতেই একজন শিক্ষার্থীকে ইংরেজি মূলবইসহ বিস্তারিতভাবে ব্যাকরণ শিখতে হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণীতে টেন্স ও পার্টস অব স্পিস বিস্তারিত জানতে হয়েছে। প্রতি শ্রেণীতে ইংরেজি ও গণিতের ওপর যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তাতে শুধু এ দু’টি বই ভালো করে আয়ত্ত করলে অন্য বই পড়ার কোনো সময় তারা পায় না। কিন্তু বাংলা, সমাজ, বিজ্ঞান, ধর্ম সবই তাদের শিখতে হচ্ছে সমান তালে। 

নাজমুন আরাসহ আরো অনেক অভিভাবক জানিয়েছেন বর্তমানে বিভিন্ন শ্রেণীতে যে ইংরেজি বই পাঠ্য করা হয়েছে, তা ইংরেজি শেখার জন্য আগের বইয়ের তুলনায় অনেক ভালো। কিন্তু বই ভালো হলেও এটি রপ্ত করার সময় তারা পাচ্ছে না। দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে প্রতি শ্রেণীতে কঠিন জ্যামিতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে বীজগণিত অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। 

শাহিদা বেগম নামে কাজীপাড়ার আরেক অভিভাবক বলেন, পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণীতে গণিত ও ইংরেজি বই যেভাবে সাজানো হয়েছে তাতে এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের দক্ষ করতে হলে আর কোনো পাঠ্যবই পড়ার সুযোগ নেই। কিন্তু সে সুযোগ তো আমরা পাচ্ছি না। ফলে শিশুদের ওপর অনেক বেশি চাপ দিতে হয়। তাদের নির্যাতন করতে হচ্ছে পড়া আদায়ের জন্য। 

কুলুসম সুমী নামে বনশ্রীর একজন অভিভাবক জানান, আমার মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। কিছু বই আছে যাতে পরীক্ষা নেয়ার নিয়ম নেই সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু প্রায় প্রতিদিন স্কুল থেকে এসব বিষয়ে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হচ্ছে। ছবি আঁকা, বাসায় বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি ক্লাসে নিতে হচ্ছে। এতে প্রচুর সময় চলে যাচ্ছে। অন্য বই পড়ার সময় পাচ্ছে না। পরীক্ষা নেয়ার নিয়ম না থাকলেও বাসায় যেসব হোমওয়ার্ক দেয়া হচ্ছে তা পরীক্ষার চেয়েও বেশি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্কুল থেকে এটি চাপিয়ে দেয়া হয়েছে আমাদের ওপর। এসবে অবহেলারও সুযোগ নেই, কারণ এসব হোমওয়ার্ক অ্যাসাইনমেন্টের নম্বরের ভিত্তিতে মেধা তালিকা তৈরি হবে বার্ষিক পরীক্ষায়। 

বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও অভিভাবকের সাথে কথা বলার সময় তারা জানিয়েছেন, সব শিক্ষার্থী সমান মেধাবী নয়। সাধারণ ও দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য বর্তমানে পাঠ্যবই একটি দুরূহ বোঝায় পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে প্রাইমারি থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত সব শ্রেণীতে গণিত বই সবচেয়ে বেশি কঠিন আর জটিল করা হয়েছে। আগের সহজ নিয়ম বাদ দিয়ে অনেক কঠিন নিয়মে সমাধান করা হচ্ছে অনেক গণিত। সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে এ গণিত বই আয়ত্ত করা এবং গণিত ভালো করে শেখা সম্ভব নয়। সরকার নানা ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে গণিত ভীতি দূর করার জন্য। কিন্তু বই যেভাবে কঠিন করা হয়েছে তাতে গণিত ভীতি আরো চেপে বসেছে। অনেক বোঝানোর পরও অনেক শিক্ষার্থী ক্লাসে ও বাসায় গণিত কিছুই বোঝে না। যতই বোঝানো হোক না কেন মুখ মলিন করে বসে থাকে আর আন্দাজে মাথা নাড়ে তারা। বোঝানোর পর গণিত করতে দিলেও পারে না তারা। 

অভিভাবকদের অভিযোগ বইয়ের বিষয় যেমন কঠিন আর ভারী তেমনি প্রতি বছর বাড়ানো হচ্ছে বইয়ের সংখ্যা। সব মিলিয়ে শুধু সাধারণ শিক্ষার্থী নয়, সবাইর জন্যই লেখাপড়া খুব কঠিন আর ভারী একটা বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক শাহ শামীম আহমেদ বলেন, মূল সমস্যা হলো আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতি আর স্কুল কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত মূল্যায়ন। একটি বই বড় হওয়া সমস্যা নয়। সমস্যা হলো তার সবই যদি শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করতে হয় তাহলে। আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতি, স্কুল কর্তৃপক্ষের ঘনঘন মূল্যায়ন আর অভিভাবকদের ভুল ধারণার কারণে শিক্ষার্থীদের পুরো বই প্রায় মুখস্থ করতে হচ্ছে। 

পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন করা হলে পুরো বইটি পড়া এবং সেখান থেকে বার্তা গ্রহণ করা হয়তো একজন শিক্ষার্থীর জন্য আনন্দের বিষয়ে পরিণত হতো। কিন্তু তা করা যাচ্ছে না পরীক্ষা পদ্ধতির কারনে। তা ছাড়া বইয়ের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেশি করা হয়েছে এটা সঠিক। আগে শারীরিক শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি, কর্মমুখী শিক্ষা এ ধরনের অনেক পাঠ্যবই ছিল না। সময়ের প্রয়োজনে এগুলোর গুরুত্বের কারণে পাঠ্য করা হয়েছে। কিন্তু অন্য অনেক জিনিস কমানো হয়নি। আগের সব ঠিক রেখে কেবল নতুন বই বাড়ানো হচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement