২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঢাবির পরীক্ষার ফলে অসংগতি, ৩২ স্থানে নম্বরের হেরফের

সবুর খান (বাঁয়ে) ও বাহাউদ্দিন - নয়া দিগন্ত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের দুই অধ্যাপকের তৈরি করা ফলাফলে অসঙ্গতির অভিযোগ উঠেছে। এ ফলাফলে অনাস্থা এনে ফল পুন:নীরিক্ষণের দাবি জানায় বিভাগের ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা। পরে অভিযোগ আমলে নিয়ে পুন:নীরিক্ষিত ফলাফলে ১১ শিক্ষার্থীর চারটি কোর্সের ৩২ স্থানে প্রাপ্ত নম্বরের কমবেশি করার প্রমাণ মেলে।

এর মধ্যে সাত শিক্ষার্থীর ফলাফলে বড় ধরনের অসঙ্গতি দেখা গেছে। পরে পুন:প্রকাশিত ফলাফলে উক্ত সাত জনের জিপিএ ও সিজিপিএ পরিবর্তন এবং দুই জনের মার্কসিট সংশোধন করে ফলাফল প্রকাশিত হয়। এ ধরণের অসঙ্গতিকে ইচ্ছামূলক বলে অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। এর পেছনে পূর্ব থেকে জমে থাকা কোনো ক্ষোভ ও মনোমালিণ্য থাকতে পারে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ঘটনায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই দুই শিক্ষকের ব্যাপারে অনাস্থা তৈরি হয়েছে। কিন্তু তাদের ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে আসেনি প্রশাসন।

জানা যায়, ২০১৭ সালের ৩য় বর্ষ ৬ষ্ট সেমিস্টারের ফলাফল চলতি বছরের ১৫ মার্চ প্রকাশিত হয়। এর টেবুলেটর হিসেবে ছিলেন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুস সবুর খান এবং অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন। প্রকাশিত ফলাফল কাক্সিক্ষত না হওয়ায় এ দুই অধ্যাপকের কাছে মৌখিক আবেদন জানান শিক্ষার্থীরা। আবেদনের প্রেক্ষিতে ঢাবির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিস থেকে উক্ত প্রকাশিত ফলাফলটি পুনরায় নিরীক্ষা করে ২৯ মার্চ সংশোধিত ফলাফল প্রকাশ করে। কিন্তু তাতেও কাক্সিক্ষত ফলাফল না আসায় ৩ মে কয়েকজন শিক্ষার্থী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বরাবর ফলাফল যাচাইয়ের আবেদন করে।

বিষয়টি আমলে নিয়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের প্রাথমিকভাবে নিরীক্ষা করলে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। তাই ডিবি (ডিসিপ্লিনারি বোর্ড) এর সাব কমিটির সভায় ফলাফল জালিয়াতির বিষয়টি উপস্থাপন করে। একই সভায় বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আবুল কালাম সরকার এবং অধ্যাপক ড. তারিক জিয়াউর রহমান সিরাজীকে নিরীক্ষক হিসেবে ফলাফল তৈরির দায়িত্ব প্রদান করে। এ দুজনের তৈরিকৃত ফলাফল ও পূর্বে পুনঃ প্রকাশিত ফলাফলের মধ্যে ব্যাপক অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হয়।

এদিকে, ৬ আগস্ট উক্ত অসঙ্গতির বিষয়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক স্বাক্ষরিত এক পত্রে এ দুই অধ্যাপককে এর কারণ জানাতে বলা হয়।

পুনঃনিরীক্ষার ফলাফল যাচাই করে দেখা গেছে, ক্লাস উপস্থিতি, মিডটার্ম এবং কোর্স ফাইনাল এ তিন ধরণের নম্বরের ক্ষেত্রে অসঙ্গতি দেখা গেছে। কোথাও আবার মূল নম্বরের থেকেও বেশি দেখানো হয়েছে। ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কোনো কোর্সে সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৫০ নম্বর পর্যন্ত গরমিল হয়েছে। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর বেলায় প্রকৃত নম্বর থেকে প্রদর্শিত নম্বর কম দেখানো হয়েছে। তবে কয়েক স্থানে প্রকৃত নম্বর থেকে প্রদর্শিত নম্বর বেড়েছে। এক ছাত্রীর ফলাফলে সবচেয়ে বড় অসঙ্গতি দেখা গেছে।

চার কোর্সে তাকে মোট ২৮ দশমিক ৫০ নম্বর কম দেয়া হয়েছে। তার ৩০৫ নম্বর কোর্সে বড় অসঙ্গতি দেখা গেছে। তার প্রদর্শিত কোর্স ফাইনাল নম্বর ২৮, পরবর্তীতে তিনি সে কোর্সে ৪১ দশমিক ৫০ নম্বর পান। এখানে তাকে ১৩ দশমিক ৫০ নম্বর কম দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৩০৬, ৩০৭ এবং ৩০৮ নম্বর কোর্সে যথাক্রমে ৩, ৩ দশমিক ৫০ এবং ৮ দশমিক ৫০ নম্বর কম দেয়া হয়। ৩০৮ নাম্বার কোর্সে এক ছাত্র ৪৪ দশমিক ৫০ পান। পরে তার ফলাফল বেড়ে হয় ৪৭ দশমিক ৫০। ৩০৭ নাম্বার কোর্সে ফাইনাল পরীক্ষায় সূর্যসেন হলের শাহিন আলম নামের এক ছাত্র ২৩ পেলেও পুনঃপরীক্ষায় তিনি পান ২৯। ৩০৫ নাম্বার কোর্সে যে শিক্ষার্থী ৪০ দশমিক ৫০ পান তিনি পুনঃপরীক্ষণে পান ৪২ নাম্বার। তবে প্রদর্শিত নাম্বার ছাড়াও পুনঃপরীক্ষণের ফলে অনেকেই বিভিন্ন কোর্সে কম নম্বরও পেয়েছেন। এর মধ্যে এক শিক্ষার্থীর ৩০৭ নম্বর কোর্সে প্রদর্শিত নম্বর ৪২ কিন্তু তার প্রকৃত নম্বর ৩১ দশমিক ৫০। এখানে ১০ দশমিক ৫০ নম্বর বাড়িয়ে দেখানো হয়।

তাদের টেবুলেটিংকৃত এ ফলাফলে দেখা যায়, সর্বমোট ১১ জন রোলধারী শিক্ষার্থীর চারটি কোর্সের ৩২টি স্থানে প্রাপ্ত নম্বর কমবেশী করার প্রমাণ মেলে। ডিবির সাব কমিটির নির্দেশক্রমে ৩০ আগস্ট ২০১৮ তারিখে সংশোধিত পুনঃ ফলাফল প্রকাশ করা হয়। পুনঃ প্রকাশিত ফলাফলে ৭ জনের জিপিএ ও সিজিপিএ পরিবর্তন ও দুই জনের মার্কশিট সংশোধন পুর্বক ফলাফল ঘোষিত হয়।

পরীক্ষা কমিটির সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রত্যেক সেমিস্টারের শিক্ষার্থীদের ফলাফল তৈরির জন্য একটি ‘পরীক্ষা কমিটি’ গঠন করা হয়। পরীক্ষার নাম্বার পূর্ণাঙ্গ ফলাফল আকারে তৈরি করতে এই কমিটির সদস্যদের দায়িত্ব থাকে। রেজাল্ট শিট তৈরির সময় মিডটার্ম, এস্যাইনমেন্ট, উপস্থিতি, সেমিস্টার ফাইনাল ইত্যাদির নম্বর কম্পিউটারে সফটওয়্যারের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। নির্দিষ্ট কোর্স শিক্ষকের দেয়া নাম্বার ওই সফটওয়্যারে বসালেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফলাফল তৈরি হয়ে যায়। পরে তা আরও কয়েকবার যাচাই-বাছাই করা হয়। পরে পুনঃপরীক্ষণের জন্য এই ফলাফলের দু’কপি বিভাগীয় প্রধান ও একটি কপি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের নিকটে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে সেটি ফলাফল আকারে প্রকাশ করা হয়।

সূত্র জানায়, মাইক্রোসফ্ট এক্সেলে পরীক্ষার ফলাফল তৈরির কাজ করা হয়। যার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্কোর তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু ফলাফল যাচাই করে ধারণা করা হচ্ছে যে এটি ম্যানুয়্যালি করা হয়েছে। জানা গেছে অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের তৈরি ফলাফলে একই ধরনের ভুল এবং একই ধরনের সংশোধনী আনা হয়েছে। সেক্ষেত্রে এটিকে ইচ্ছামূলক অসঙ্গতি বলেছেন অনেকে।

এ বিষয়ে জানতে প্রধান পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মোঃ বাহালুল হক চৌধুরীর সাঞে যোগাযোগ করতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ঢাকার বাইরে আছি। ব্যস্ত আছি।

অধ্যাপক ড. আবদুস সবুর খানের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদকের ওপর ক্ষিপ্ত হন। প্রথমে কারণ দর্শানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হু আর ইউ?’ পরে তিনি বলেন, ‘আমি ফোনে কথা বলতে চাই না।’

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন বলেন, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এমনটা হয়েছে। এগুলোকে ভুল উল্লেখ করে তা সংশোধন করা হয়েছে জানান তিনি। এ ধরনের বিষয় নিয়ে রিপোর্ট হলে বিশ^বিদ্যালয়ে কেই টেবুলেটিং করতে পারবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। শিক্ষার্থীদের সাথে ব্যক্তিগত কোনো বিষয় ছিলো না বলে জানান তিনি।

জানতে চাইলে বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আবুল কালাম সরকার নয়া দিগন্তকে বলেন, কিছু অসঙ্গতি ছিলো। পরে তা সংশোধন করা হয়েছে।

এদিকে, অভিযোগ ও ফলাফলে ব্যাপক অসঙ্গতির বিষয়টি আলোচিত হওয়ায় এ ব্যাচের শিক্ষার্থীগণ এ শিক্ষকদের রোষানলে পড়ার আশঙ্কা করছেন। অন্যদিকে, বিশ^বিদ্যালয়ের কোন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আসলে তার বিরুদ্ধে বিশ^বিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হয়। এর আগে এমন এমন অভিযোগে বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগ এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষকের চাকরিচ্যুতির দৃষ্টান্ত রয়েছে। তবে ঘটনার অনেক দিন পরেও এই দুই শিক্ষকের ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে আসেনি বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, বিশ^বিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক ওই শিক্ষার্থীদের ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে যেন তারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এখন দ্বিতীয় পর্যায়ে আমরা ক্ষতিয়ে দেখছি যে কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।

সার্বিক বিষয়ে ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জমান বলেন, আমি বিষয়টি জেনেছি। এ বিষয়ে তাদের ডেকেছি। কোনো শিক্ষার্থী কোনোভাবে ভুক্তভোগী হবে এটা কোনোভাবেই বরদাস্ত করা যাবে না।


আরো সংবাদ



premium cement