২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

'কেউ যদি আমার বাচ্চার গায়ে এভাবে হাত দিতো জ্যান্ত পুঁতে ফেলতাম'

'কেউ যদি আমার বাচ্চার গায়ে এভাবে হাত দিতো জ্যান্ত পুঁতে ফেলতাম' - ছবি : সংগৃহীত

রাজধানী ঢাকায় বাসের চাপায় রোববার দুপুরের দিকে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর প্রতিবাদে রাস্তায় বিক্ষোভ করছে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা। এদিকে এই বিক্ষোভে সমর্থন জানিয়েছে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ।

বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মায়েরা সমর্থন জানিয়েছে তাদের এ আন্দোলনকে। সেলিনা মোমেন নামে একজন নারী বলছেন "আন্দোলন চলুক। সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যাক"।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে করে তিনি বলেছেন, "বন্ধ করে দে ঢাকাকে। তোদের নিরাপত্তা না দিতে পারলে এই সরকার আমি চাই না।"

স্কুলের শিক্ষার্থীদের এ ধরণের ব্যাপক মাত্রায় বিক্ষোভ সচরাচর দেখা যায় না।

কতটা অনিরাপদ ঢাকার গণপরিহণ
তবে ঐ দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর প্রতিবাদে রাস্তায় বিক্ষোভ করার সময় গতকাল মঙ্গলবার ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে এবং স্কুলের এলাকায় বিক্ষোভ করে।

পরে ঢাকায় কয়েক রুটের যানবাহন চলাচল ব্যাহত হয়। এর এক পর্যায়ে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়।

সেসব ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক সমালোচনা হতে থাকে স্কুলের শিক্ষার্থীদের উপর এধরনের লাঠি চার্জের ঘটনায়।

সাবিনা সাবি নামে আরো একজন নারী বলেছেন, "আমাদের বাচ্চাদের নিরাপত্তা নিয়ে যখন প্রশ্ন তখন একজন মা হয়েই কথাটা বললাম। আমাদের মানবিকতার উন্নয়ন হোক। এটা একটা মায়ের দাবী।"

এদিকে আজ বুধবারেও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভের খবর পাওয়া যাচ্ছে।

বিমানবন্দর রোডে, উত্তরা, ফার্মগেট, শনির আখড়া, বাংলা মোটর থেকে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করছে।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে ফারহানা হক নামে আরেকজন মা বলছেন "সকাল হলেই ভয় হয়, কেন জানেন? বাচ্চা স্কুলে যাবে তো"।

তিনি বলছিলেন, ঘুম আসে না এটা ভেবে যে, ছেলে কে কি কাল স্কুলে দিব, আমরা কেউ নিরাপদ না।

কেয়া খানম নামে আরেকজন মা লিখেছেন, "আমরা নিরাপদ সড়ক চাই। কারণ আমাদের সন্তান রাস্তায় বের হলে যেন নিশ্চিন্তে থাকতে পারি যে আমার রান্না করা ভাত আমার সন্তান স্কুল থেকে ফিরে এসে খাবে।"

গতকাল রাস্তায় বেশ কিছু বাস ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। ফলে যাত্রীদের ভোগান্তি ছিল চরমে উঠে।

আজকেও রাস্তায় বাস চলাচল সীমিত রয়েছে বলে সংবাদদাতারা জানাচ্ছেন।

বিলকিস ওয়াজি ঝিনুক নামে একজন মা বলছেন, তারও ছেলে আছে। ফেসবুকে একটা শিশুকে একজন পুলিশ গলা চেপে ধরে আছে সেটা দেখে ক্ষোভে ফেটে পরেন তিনি।

তিনি বলেন, "ওই যে গলা চেপে ধরেছে ওই ছেলেটা আমার ছেলের বয়সী। কেউ যদি আমার বাচ্চার গায়ে এভাবে হাত দিতো জ্যান্ত পুঁতে ফেলতাম।"

আরো পড়ুন :

মালিক যত ক্ষমতাধর চালক ততই বেপরোয়া
আবু সালেহ আকন

আবু ইউসুফ। পুলিশের একজন অ্যাডিশনাল এসপি। সিলেট রেঞ্জে কর্মরত রয়েছেন। দীর্ঘদিন ঢাকার ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত ছিলেন। সেই সুবাদে ঢাকার ট্রাফিক বিভাগ ও যানবাহন নিয়ে তার অভিজ্ঞতা অনেক। তিনি তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘ট্রাফিকের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, মালিক যত পাওয়ারফুল, ড্রাইভার তত পাওয়ার দেখায়।’ 

শুধু পুলিশ বিভাগের একজন কর্মকর্তা নন, ক্ষমতার এই দাপট হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন সাধারণ মানুষও। ক্ষমতার দাপটে তারা আইনকে থোরাই কেয়ার করে। আর চালকদের এই ক্ষমতার উৎস তাদেরই মালিকরা। মালিকদের মধ্যে রয়েছেন রাজনৈতিক নেতা, শিল্পপতি, প্রভাবশালী লোকজন, এমনকি ক্ষমতাসম্পন্ন সরকারি কর্মকর্তারা। এই ‘পদমর্যাদার’ লোকদের সুবিধা হলোÑ তাদের কোম্পানির গাড়ি থেকে চাঁদা দিতে হয় না, কাগজপত্র ঠিক না থাকলেও বিআরটিএ কিছু বলে না, রাস্তায় পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হয় না-ইত্যাদি। যে কারণে এই দাপুটে লোকদের অনেকেই পরিবহন ব্যবসার সাথে জড়িত। মন্ত্রী-এমপিদেরও অনেক গাড়ি নির্বিঘেœ রাস্তায় চলছে। এসব গাড়ি কাউকে চাপা দিয়ে মেরে ফেললেও কিছু যায় আসে না; এমনই অভিযোগ রয়েছে। আবার অনেকে রয়েছেন যাদের একটি গাড়িও নেই কিন্তু পরিবহন কোম্পানি খুলে বসেছেন। কোম্পানির নামে তারা বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়ি চালান। বিনিময়ে তারা পান মাসোয়ারা। কোনো পুঁজি বিনিয়োগ না করেই তারা বসে বসে গাড়িপ্রতি দিনে ৫০০-১০০০ টাকা নিয়ে যান।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীসহ অর্ধশতাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি পরিবহন ব্যবসায় জড়িত। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন রয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা। তাদের নিয়ন্ত্রণেই রাজধানীসহ সারা দেশের পরিবহন ব্যবসা। আর এমন ব্যক্তিদের গাড়িতেই বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। এই পরিবহন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আরো অনেক অভিযোগ রয়েছে। রাজধানীর মিরপুর থেকে চলাচলকারী চয়েজ, সিল্কসিটি, বিকল্প, বিহঙ্গ, শিখর, ইটিসি, ইউনাইটেড, দিশারী, নিউভিশন, সুপার সিটিং, শিকড়সহ বিভিন্ন কোম্পানির মিনিবাস সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলছে। এ ছাড়া বিমানবন্দর সড়কে চলাচল করছে প্রভাতী, আজমেরী, সুপ্রভাত স্পেশাল ও গাজীপুর পরিবহন। গুলিস্তান-ধামরাই রুটের বাস দিশারী, গাবতলী মিনিবাস মালিক সমিতি, নিউ ভিশন, ভুঁইয়া, মৌমিতা, তেঁতুলিয়া, ঠিকানা, সাভার, নূরজাহান মানিকগঞ্জ, ফুলবাড়িয়া, প্রজাপতি, লাব্বাইক, আশীর্বাদ, প্রজাপতি, হিমাচল ও বসুমতী, মতিঝিল থেকে মোহাম্মদপুরগামী মৈত্রী, এটিসিএল, দীপন পরিবহনের বাসগুলো যাত্রী হয়রানির ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে। এর বেশির ভাগের মালিক হলেন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক লোকজন। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের সাথে তারা কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত রয়েছেন।

আবার কখনো কখনো দেখা গেছে রাজনৈতিক বৈরী হাওয়ায় রাতারাতি এসব কোম্পানির মালিক পরিবর্তন হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, শুধু ব্যবসা করার জন্যই এই খোলস পরিবর্তন। রাতারাতি কোম্পানির নাম পরিবর্তনের ঘটনাও ঘটেছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপর কনক পরিবহন মিরপুর থেকে আগারগাঁও, মহাখালী, কাকলী হয়ে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত রুটে ১৫টি বাস নামানোর অনুমতি পায়। এরূপ আরো বেশ কয়েকটি পরিবহন কোম্পানি রয়েছে; যার সাথে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা সরাসরি জড়িত। গত রোববার জাবালে নূর নামে যে বাস হোটেল রেডিসনের সামনে দুই শিক্ষার্থীকে ফুটপাথে পিষে মেরেছে ওই পরিবহনের উদ্যোক্তা অরাজনৈতিক হলেও এর পরিচালক হিসেবে রয়েছেন মিরপুর যুবলীগের এক নেতা। আরেকজন পরিচালক হচ্ছেন এক মন্ত্রীর আত্মীয়। প্রজাপতি পরিবহনের মালিক আওয়ামী লীগের মিরপুরের এক সাবেক এমপি। বসুমতী পরিবহন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহর। আজিমপুর থেকে উত্তরা রুটে চলাচলকারী ‘সূচনা-বিআরএফ’ পরিবহনে রয়েছে সাবেক এক প্রতিমন্ত্রীর ছেলের বাস।

একজন প্রভাবশালী এমপির চাচাতো ভাইয়ের বাসও চলে ‘সূচনা-বিআরএফ’ পরিবহনে। রাজধানীতে গাড়িচাপায় সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছে তেঁতুলিয়া পরিবহন। মোহাম্মদপুর থেকে মিরপুর হয়ে আবদুল্লাহপুর রুটে পরিচালিত এই পরিবহনে অনুমোদিত গাড়ি আছে মাত্র ৫০টি। অথচ একই সাইনবোর্ডে ১৩০টিরও বেশি গাড়ি চলাচল করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তেঁতুলিয়া পরিবহন কোম্পানির চেয়ারম্যান ভোলার এক এমপি। জানা যায়, মাত্র আড়াই বছরে তেঁতুলিয়া গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে ও বেপরোয়া চালানোজনিত দুর্ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তির মৃত্যু ঘটেছে। প্রভাবশালী হওয়ায় এই পরিবহনের কোনো চালককে আইনের আওতায় নেয়া যায় না।

আজিমপুর, মিরপুর-১২, কুড়িল ও সদরঘাট রুটে চলাচলকারী বিহঙ্গ নামে পরিবহনের গাড়ির সংখ্যা ৩০০ এর ওপরে। তবে সবই লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা। বিহঙ্গ পরিবহন কোম্পানির চেয়ারম্যান স্বেচ্ছাসেবক লীগের একজন শীর্ষ নেতা। মালিক সমিতির অনেক নেতা রয়েছেন যাদের গাড়ি নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটায়। কিন্তু তারপরও কোনো বিচার হয় না।


আরো সংবাদ



premium cement