২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

‘মিডিয়ার সামনেই মারছে, ভাবুন অগোচরে কী করে’

কোটা
লুৎফুন্নাহার লুনা ও রাশেদা রওনক খান - ছবি : বিবিসি

বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে গত কয়েক দিনে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। দ্রুত কোটা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপনের দাবিতে ফের আন্দোলনে যেতে চাইলে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান দেখা গেছে।

গ্রেফতার করা হয়েছে আন্দোলনকারীদের মুখপাত্রসহ শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতাকে। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দফায় দফায় হামলা ও মারপিটের ঘটনা ঘটেছে।

আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা এবং গ্রেফতারের মধ্যেই সোমবার কোটা সংস্কার নিয়ে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার।

আন্দোলনরত সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক লুৎফুন্নাহার লুনা বিবিসিকে বলেন, তাদের বহু নেতাকর্মী হামলায় আক্রান্ত হয়েছেন। অনেকে গ্রেফতার ও হামলার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে তিনি জানান।

‘আমরা কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথায় আন্দোলন থামিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রায় তিন মাসেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। আমরা চাই দ্রুত সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন দিক।’

শনিবারের সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে সোমবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মানব-বন্ধন ও পতাকা মিছিলের কর্মসূচি ছিল। সেটিও পণ্ড করে দেয়া হয়েছে হামলা চালিয়ে।

লুৎফুন্নাহার লুনা বলেন, ‘এখন আমাদের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে। আপনারা দেখছেন মিডিয়ার সবার সামনে আমাদেরকে মারছে। তাহলে ভাবেন মিডিয়া যখন না থাকে অগোচরে তাহলে কী করে। আমাদেরকে তারা বলে তোরা রাস্তায় বের হতে পারবি না। আমাদের পরিবারকে গুম করে দিবে।’

লুনার অভিযোগ সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকেই এসব হুমকি আসছে এবং হামলার ঘটনা ঘটছে।

‘যেখানে পাচ্ছে তারা খুঁজে খুঁজে মারছে। আমাদের হলে থাকতে দিচ্ছে না। আমাদের ছবি মার্কিং করছে। প্রশাসনের ভয়ে নুরুলকে মধ্য রাতে হাসপাতাল থেকে বের করে দিয়েছে। ফারুককে ছাত্রলীগের ছেলেরা পিটিয়ে মোটরসাইকেলে করে নিয়ে গেছে,’ বলেন তিনি।

শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা বিষয়ে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবিদ আল হাসানের দাবি, আন্দোলনকারীদের মধ্যে গ্রুপিং হয়েছে। তাদের সঙ্গে এখন সাধারণ ছাত্ররা নেই।

‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব যেমন প্রশাসনের তেমনি সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও রয়েছে। আপনারা যদি মনে করেন আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা, তার আগে তো আমাদের পরিচয় আছে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থী।’

শহীদ মিনারে হামলায় ছাত্রলীগের বিভিন্ন হল শাখার নেতাদের জড়িত থাকার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোটা আন্দোলনের নামে বিভিন্ন রকম উসকানিমূলক এবং গুজব ছড়ানো হচ্ছে। সারা বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে। এরকম পরিবেশ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে জামাত শিবিরের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারাই আসবে ছাত্রলীগ তাদের প্রতিহত করবে।’

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ধৈর্য নিয়ে একদিকে যেমন বিতর্ক হচ্ছে, তেমনি কোটা বাতিল ঘোষণার পর এ নিয়ে নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য ও কার্যক্রমে অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে বলেও সমালোচনা হচ্ছে। সবমিলিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন, সরকারের অবস্থান এবং আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা, মামলা পুরো পরিস্থিতিকে জটিল করেছে বলেই অনেকে মনে করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান বিবিসিকে বলেন, যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে সেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।

তার মতে আন্দোলনের একটা ভিন্ন রূপ দাঁড়িয়ে গেছে নানা কারণেই, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটা ঘোষণা দিয়েছেন সেটা সময় নিয়ে একটু দেখা যে কী হচ্ছে এটা একটা বিষয়। আবার এমন নয় যে চাপ দেয়া যাবে না, অবশ্যই আন্দোলনকারীরা চাপ দিতেই পারেন। যে কোনো দাবি দাওয়ার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের ওপরে চাপ প্রয়োগ করাটাই আন্দোলনের ধর্ম। কিন্তু সেই আন্দোলনে কোনোরকম আক্রমণ করা, অন্য ছাত্র সংগঠনের আক্রমণ করা সেটাও একটা গর্হিত কাজ।’

কোটা সংস্কার বা এই নামে যেকোনো আন্দোলন প্রতিহত করতে সরকারের কঠোর অবস্থান স্পষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হামলার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নাগরিক সমাজও আক্রান্ত হয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন মনে করেন, ক্যাম্পাসের বর্তমান পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব ছিল।

তিনি বলেন, ‘যথেষ্ট কালক্ষেপণ হয়েছে। এটা নিয়ে কালক্ষেপণ করার কিছু ছিল না। এই কমিটি তৈরি আসলে অনেক আগেই করা যেত। এই ব্যবস্থাগুলো আরো আগে নেয়া যেত। এই যে অপ্রীতিকর শুধু নয় একটা ভয়ংকর অবস্থা তৈরি হলো, যে বিশ্বাস মানুষের মন থেকে নষ্ট হলো, যে চিত্রগুলো অভিভাবকদের সামনে উপস্থাপিত হলো, সেগুলো আসলে বন্ধ করা যেত। আমি মনে করি যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের অধিকতর দায়িত্ব ছিল।’

এখন সরকার কোটা সংস্কারের বিষয়ে কমিটি করলেও আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা, মামলা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চাপা ক্ষোভ এবং উত্তেজনা কাজ করছে।

আরো পড়ুন :

ছাত্রলীগের হাতুড়ি পেটায় আহত তরিকুলকে ন্যূনতম চিকিৎসাসেবা নেয়ার সুযোগ দেয়া হলো না
রাজশাহী ব্যুরো ও রাবি সংবাদদাতা, ০৫ জুলাই ২০১৮
তরিকুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র। বাড়ি গাইবান্ধায়। তরিকুলরা দুই ভাই ও এক বোন। তিন ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় তরিকুল। গত সোমবার (২ জুলাই) কোটা সংস্কারের দাবিতে পূর্বঘোষিত শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কর্মসূচিতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের হামলায় মারাত্মক আহত হন তিনি। পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের ৩১ নং ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে এক্স-রেসহ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে, তরিকুলের ডান পা ভেঙে গেছে। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন। আট-নয়টি সেলাই পড়েছে মাথায়। নৃশংস হামলায় সারা শরীরে ত নিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তিনি। অন্যের সহযোগিতা ছাড়া চলতে পারছেন না তিনি। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে বেশ সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু রামেকে ন্যূনতম চিকিৎসাসেবা নেয়ার সুযোগটুকুও তাকে দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন তার পরিবারের সদস্যরা। তারা বলছেন, জোর করেই তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র ধরিয়ে বের করে দেয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে আহত তরিকুলের বোন ফাতেমা খাতুন অভিযোগ করে নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা বারবার বলেছি, তরিকুলের অবস্থা ভালো নয়। এখনো মারাত্মক অসুস্থ। পুরোপুরি সুস্থ হতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু কেউই কোনো কথা শুনেননি। হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, এখানে থাকার প্রয়োজন নেই। দুই সপ্তাহ পরে এসে দেখা করবেন। তারা ছাড়পত্র ধরিয়ে বের করে দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে নগরীর রয়্যাল হাসপাতালে ভর্তির প্রক্রিয়া চলছে।

গতকাল বিকেলে দেখা গেছে, তরিকুলকে নগরীর রয়্যাল হাসপাতালে নিয়ে ভর্তির প্রক্রিয়া চলছে। হামলায় ক্ষতবিক্ষত তরিকুল মানসিকভাবে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছেন। পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনসহ সহপাঠী ও বন্ধুরা তার পাশে রয়েছেন।
তবে তরিকুল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ঘটনাস্থলে পুলিশ উপস্থিত থাকলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। পুলিশ সক্রিয় হলে হয়তো তাকে এই কঠিন পরিস্থিতির শিকার হতে হতো না। আর ছাত্রলীগের হামলাকারী নেতাকর্মীদের বারবার অনুরোধ ও কাকুতি-মিনতি করলেও তারা কর্ণপাত করেনি। তারা নির্দয়ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যে যা দিয়ে পেরেছে পিটিয়েছে। তিনি বলেন, একপর্যায়ে বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম।

কোটা সংস্কারের দাবিতে বিােভ কর্মসূচিকালে গত সোমবার (২ জুলাই) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেটের সামনে রাস্তায় নির্দয়ভাবে তরিকুলকে পিটিয়ে মারাত্মক জখম করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, সোমবার কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণে চাপাতি হাতে ছাত্রলীগ কর্মী লতিফুল কবির মানিককে। হাতুড়ি হাতে দেখা গেছে, ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক ও সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল মামুনকে। বিভিন্ন ছবিতে বাঁশের লাঠি হাতে সবার সমানে ছিল সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদি হাসান মিশু। বিভিন্ন ছবিতে তরিকুলকে মারধরে তাদের আগ্রাসী ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে।

এরা ছাড়াও আক্রমণে মূল ভূমিকায় আরো ছিলেন- রাবি ছাত্রলীগের সহসভাপতি গোফরান গাজী, মিজানুর রহমান সিনহা, রমিজুল ইসলাম রিমু, সাদ্দাম হোসেন, আহমেদ সজীব, ছানোয়ার হোসেন সারোয়ার, আরিফ বিন জহির, সাংগঠনিক সম্পাদক সাবরুল জামিল সুষ্ময়, হাসান লাবন, ইমতিয়াজ আহমেদ, প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক আসাদুল্লাহ হিল গালিব, কর্মী জন স্মিথ ও রাশেদ খান। পরে পুলিশ ও সাংবাদিক মিলে তাকে রামেক হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে। তরিকুল কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরণ পরিষদের রাবি শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক।

এ দিকে তরিকুলের অবস্থা সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হলে হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের প্রধান এম এ কে শামসুদ্দিন নয়া দিগন্তকে বলেন, তার অবস্থা একটু ভালো। তিন সপ্তাহ পরে আসতে তাকে বলা হয়েছে। তবে তরিকুলকে জোর করে ছাড়পত্র ধরিয়ে বের করে দেয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি বাইরে আছি। এ সম্পর্কে তিনি অপর একজন চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।

তবে হাসপাতালের একটি সূত্র তরিকুলকে জোর করে ছাড়পত্র ধরিয়ে বের করে দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। সূত্রটি জানিয়েছে, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কারো কোনো গাফিলতি নেই।


আরো সংবাদ



premium cement