২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন

ব্যর্থতার আরেক উদাহরণ

-

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, দীর্ঘ এক দশকেও একটি আইন তৈরি করতে পারেনি সরকার। এক দশকে অসংখ্য আইন প্রণয়ন ও পাস করা হলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের অপারগতা রীতিমতো বিস্ময়কর। গতকাল সোমবার দেশের গণমাধ্যমে প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের খবরটি এসেছে গুরুত্বের সাথে। বিশেষভাবে গুরুত্ব পাওয়া বিষয়টি হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টিউশন ফি নির্ধারণে সরকারের অনুমোদন লাগবে। টিউশন ফি কত হবে, তা সরকার নির্ধারণ করে দেবে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এই আইন প্রণয়নে এক দশক সময় লাগবে কেন?
আমাদের জানা মতে, ২০১০ সালে শিক্ষানীতি প্রণয়নের পর শিক্ষা আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই আইনের প্রথম খসড়া তৈরি করে ২০১২ সালে। পরে নানা বিষয় সংযোজন-বিয়োজন করে জনমত যাচাইয়ের জন্য ২০১৩ সালে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। এরপর তা মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করা হলে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়। মন্ত্রিসভার পর্যবেক্ষণের আলোকে আইনের খসড়া পরিমার্জন, সংশোধন করে আবারো তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাতে মন্ত্রণালয়ের সময় লাগে মাত্র (!) চার বছর। ২০১৭ সালে খসড়াটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হলে তাতে ব্যাপক অসামঞ্জস্য, বৈপরীত্য ও বিদ্যমান বিভিন্ন আইনের সাথে নানা অসঙ্গতি ধরা পড়ে। তাই আবারো এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ফেরত পাঠানো হয়। এরপর পেরিয়ে গেছে আরো তিন বছর, কিন্তু আইনটি আর আলোর মুখ দেখেনি। আমরা সবিস্ময়ে লক্ষ করি, অন্যতম বৃহৎ একটি মন্ত্রণালয়ে একটি আইনের সুষ্ঠু মুসাবিদা তৈরির মতো যোগ্য লোকও নেই। এটি সার্বিকভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্গত গলদ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এ কেবল আমলাদের ব্যর্থতা নয়। ব্যর্থতা মূলত রাজনৈতিক নেতৃত্বের। যোগ্য ও দক্ষ জনসম্পদ তৈরির দিকে এরা যত না মনোযোগী, পেশিশক্তির পরিপোষণের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার বিষয়ে ততোধিক নজর এদের।
গত এক যুগে সব শিক্ষাঙ্গনে পেশিশক্তির যে বিপুল আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তাতে লেখাপড়ার পরিবেশ কোথাও অবশিষ্ট নেই। আরেকটি ক্ষতিকর উদাহরণ হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির বিষয়টিকে অযৌক্তিকভাবে ব্যবহার করা। আগের শিক্ষামন্ত্রীর সময় বলা হয়, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পাসের হার সন্তোষজনক না হলে সেটির এমপিওভুক্তি বাতিল করা হবে। এর ফলে প্রথমবারের মতো অভূতপূর্ব নৈরাজ্য শুরু হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। পরীক্ষার হলে শিক্ষকরা ব্ল্যাকবোর্ডে প্রশ্নের উত্তর লিখে দেন, যা দেখে দেখে শিক্ষার্থীরা খাতায় লিখবে। বিশ্বের আর কোনো দেশে শিক্ষা নিয়ে এমন অবিশ্বাস্য মশকারার নজির দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না।
শিক্ষাব্যবস্থায় বিপর্যয়ের আরেকটি কারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনৈতিক ও অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দেয়া। দেশের বেসরকারি স্কুল-কলেজে গভর্নিং বডির অন্যায় হস্তক্ষেপে শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের গভর্নিং বডির সভাপতি করার সুবাদে মূলত চাঁদাবাজ, দখলবাজ, টেন্ডারবাজ এমনকি মাদক কারবারিরাও গভর্নিং বডির সভাপতি পদে থাকার পরিণতিতে শিক্ষার ন্যূনতম মানও আর অবশিষ্ট থাকেনি।
খসড়া শিক্ষা আইনে বলা হয়েছে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি বা পরিচালনা কমিটি বা চেয়ারম্যান তাদের নির্ধারিত এখতিয়ারের বাইরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনে বা পাঠদানে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। করলে কমিটি বাতিল বা চেয়ারম্যানকে অপসারণ করতে পারবে সরকার। এসব বিধি দৃশ্যত খুব ভালো। কিন্তু মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা ভিন্ন।
তার পরও আমরা প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে যেসব ইতিবাচক বিধি-ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে তাকে স্বাগত জানাই। শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের চলমান প্রক্রিয়া থেকে বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী বেরিয়ে আসতে পারবেন কি না, সেটি বোঝা যাবে শিক্ষা আইন কতটা সুষ্ঠুভাবে প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে পারেন তা থেকেই।


আরো সংবাদ



premium cement