২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
মানবপাচার মামলার বিচার হয় না

এ অপরাধ রয়েছে অব্যাহত

-

‘গত সাত বছরে ৬২১টি মামলার একটারও কোনো বিচার হয়নি। এ দিকে থামছে না বাংলাদেশ থেকে মানবপাচার।’ একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনের শুরুতেই এ তথ্য দেয়া হয়েছে। এটা শুধু কক্সবাজার জেলার হিসাব। তা থেকে অনুমান করা যায়, গোটা দেশ মিলিয়ে পাচারপরিস্থিতি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডে আবিষ্কৃত হয়েছিল পাচারকারীদের ফাঁদে পড়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের গণকবর। এরপর ২০১৮ সাল পর্যন্ত মানবপাচার ছিল বন্ধ। এখন আবার দুষ্টচক্র বিশেষ করে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের বিদেশে চাকরিসহ উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে প্রতারণা করছে। গত এক বছরে ৭৯৬ জন রোহিঙ্গা এবং দু’জন বাংলাদেশী নাগরিককে পাচারকালে উদ্ধার করা হয়েছে। জানা গেছে, রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের ৩৪টি শিবিরে অর্ধ সহস্র দালাল সক্রিয় রয়েছে।
কক্সবাজারের রামু উপজেলার এক নারীকে নেপালে ‘ভালো চাকরি’ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়েছিল মানবপাচারকারীরা। ২০১৪ সালের আগস্টে তাদের খপ্পরে পড়ে ওই নারীর ঠাঁই হয় খুলনার যৌনপল্লীতে। পুলিশ তাকে উদ্ধার করেছে। পাঁচ মাস পরে তিনজন পাচারকারীর বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেছে সে মেয়ের পরিবার। আট মাস পরে এদের আসামি করে পুলিশ চার্জশিট দিলেও আজ পর্যন্ত একজনও ধরা পড়েনি; বিচার তো দূরের কথা। জানা যায়, কক্সবাজার জেলায় ৬২১টি মানবপাচার মামলার বিচারকাজ আজো ‘চলছে’। এমন দীর্ঘসূত্রতায় পাচারকারী ও তাদের দালালরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অপর দিকে, পাচারের শিকার হয় ভুক্তভোগী যেসব পরিবার, তারা দুর্বিষহ যন্ত্রণা ভোগ করছে।
বাংলাদেশে বিশেষত দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের সমুদ্র উপকূল দিয়ে মানবপাচার অব্যাহত রয়েছে। সাধারণত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিপন্ন নর-নারী এই পাচারকারীদের প্রধান টার্গেট। এবার এমন অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী বেআইনি পন্থায় মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে নাফ নদীতে নৌযান ডুবির শিকার হয়েছে। বাংলাদেশের কোস্ট গার্ডরা তাদের অনেককে উদ্ধার করছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, সন্ধ্যার পর অরক্ষিত থাকে কক্সবাজারের ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূল। তখন এর বিভিন্ন পয়েন্টে মানুষ পাচার করা হলেও তা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। আসলে শীতকালে সমুদ্র উত্তাল না থাকার সুযোগে পাচারকারীদের এ সময় বেশি তৎপর হতে দেখা যায়। এরা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের প্রলোভন দেখায় ও বিভ্রান্ত করে থাকে, তাদের ছেলেদের কর্মসংস্থান এবং মেয়েদের বিয়ের সুব্যবস্থা করে দেবে বলে।
এ দিকে, কক্সবাজারের আদালত সূত্রের খবর, ২০১২ সালে মানবপাচার আইন চালু হওয়ার পর থেকে গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত এ জেলায় ৬৩৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এগুলোর ১৭০টি সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালে এবং বাকিগুলো আটটি থানায় দায়ের করা হয়। বর্তমানে তিন ট্রাইব্যুনালে ৬২১টি মামলার বিচার চলছে এবং ১৬টি মামলা হয়ে গেছে খারিজ। একজন সহকারী সরকারি কৌঁসুলি (এপিপি) জানান, গত বুধবার পর্যন্ত ৬২১ মামলার কোনোটার বিচার সম্পন্ন হয়নি। আরো জানা যায়, আইন মোতাবেক, অপরাধগুলোর বিচারের জন্য দায়রা জজ অথবা অতিরিক্ত জজ পর্যায়ের বিচারকের সমন্বয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার কথা থাকলেও আজো কোনো জেলায় তা গঠন করা হয়নি। এই দীর্ঘসূত্রতার দরুন বিচারপ্রার্থীরা ন্যায়বিচার থেকে হচ্ছেন বঞ্চিত।
বেআইনিভাবে ও অসৎ উদ্দেশ্যে বহু নর-নারীকে এ দেশ থেকে বাইরে পাচার করে দিয়েছে ও দিচ্ছে সঙ্ঘবদ্ধ দালালরা। এই জঘন্য অপরাধ কঠোরভাবে দমন করাই সময়ের দাবি এবং সবার প্রত্যাশা। এ জন্য দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করে এবং মামলার জট সৃষ্টি না করে, যত শিগগির সম্ভব ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা উচিত। অন্যথায় মানবপাচার শুধু অব্যাহত থাকবে না; এর মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে বেপরোয়া দালালদের দৌরাত্ম্যে।


আরো সংবাদ



premium cement