২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
ধর্ষককে গুলি করে হত্যার দাবি

আমরা হতবাক শঙ্কিত

-

জাতীয় সংসদে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন ক্ষমতাসীন দলের একজন এমপি। তিনি বলেছেন, টুপি-দাড়ি মাথায় নিয়ে আল্লাহকে হাজির নাজির জানিয়ে বলছি, এদের ক্রসফায়ার করলে বেহেশতে যাওয়া যাবে। কোনো অসুবিধা নেই। এদের বলতে তিনি বুঝিয়েছেন ধর্ষকদের । গত মঙ্গলবার সংসদে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণের দাবি ওঠে। এ বিষয়ে সংসদে দুই ঘণ্টা আলোচনা করার প্রস্তাব আসে।
ধর্ষককে ক্রসফায়ারে কিংবা বন্দুকযুদ্ধে দেয়ার পক্ষে মত দিয়ে সংসদে বক্তব্য দিয়েছেন সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যরা। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধানেরও দাবি করেছেন তারা। ধর্ষকের ক্রসফায়ারের প্রসঙ্গের অবতারণা করেন জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু। পরে ওই দলের আরেক সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ একই দাবি করেন। পরে তাদের সাথে একমত পোষণ করে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, মাদকের ব্যাপারে যদি সাথে সাথে শেষ করে দেয়া যায় ধর্ষণে কেন যাবে না। ভারতে একজন ডাক্তার মেয়ে বাস থেকে নামার পর চারজন তাকে নিয়ে গণধর্ষণ করে। দু-তিন দিন পর ক্রসফায়ার দিয়ে তাদের হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর ভারতে আর কোনো ঘটনা ঘটেনি।
তোফায়েল আহমেদ দেশের একজন শীর্ষ রাজনীতিক। বর্ণাঢ্য তার রাজনৈতিক জীবন। তিনি কোনো অভিমত ব্যক্ত করলে তাকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। সুতরাং তার সর্বশেষ বক্তব্যটি বিবেচনার দাবি রাখে। প্রথম কথা হলো, মাদকের কারণে কাউকে শেষ করে দেয়া যায় এ কথা গ্রহণযোগ্য নয়। দেশের কোনো আইন-আদালত বা সংসদ মাদক কারবারি বা পাচারকারীকে নির্বিচারে গুলি করে মারার অনুমোদন দেয়নি। এটি সর্বতোভাবেই একটি বেআইনি হত্যামাত্র। একইভাবে ভারতে চারজন ধর্ষণকারীকে ক্রসফায়ারে হত্যা করাও সুস্পষ্টভাবে বেআইনী হত্যা। এ ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে তা হলো, বিচারালয়ের এখতিয়ার নিজের হাতে তুলে নিয়েছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। এই এখতিয়ার কারো নেই। সাধারণ মানুষের জন্য আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া যদি অপরাধ হয়; তাহলে সেটি আইন প্রয়োগকারীদের জন্যও বেআইনি।
তোফায়েল আহমেদের দ্বিতীয় বক্তব্য, চার ধর্ষণকারীকে ক্রসফায়ারে হত্যার পর ভারতে আর কোনো ঘটনা ঘটেনি। এটি বাস্তবতা থেকে বহু দূরের একটি ‘ভ্রান্ত পর্যবেক্ষণ’। ভারতে ধর্ষণ শুধু বাড়েইনি, রেকর্ড পর্যায়ে চলে গেছে। অতি সম্প্রতি চাঞ্চল্যকর একাধিক ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে ভারতজুড়ে যে তোলপাড় চলছে সম্ভবত সেসব তথ্য সচেতন কারোই নজর এড়ানোর কথা নয় । তার মন্তব্য প্রসঙ্গে শেষ কথা এই যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই প্রথম ক্রসফায়ার হয়েছিল। সেই বেআইনি হত্যার পর তখন গলা ফাটিয়ে দম্ভ প্রকাশ করা হয়েছিল। ক্রসফায়ারের পক্ষে এ ধরনের বক্তব্য বা দম্ভ প্রকাশ গ্রহণযোগ্য হয়নি।
আমরা হতবাক হই যে, একটি দেশের খোদ আইন প্রণেতাদেরই আইন-আদালতের প্রতি কতটা অনাস্থা থাকলে তারা এ ধরনের বিচারবহির্ভূত ও সম্পূর্ণ বেআইনি একটি কাজের বৈধতা দেয়ার প্রস্তাব করতে পারেন। তারা কি কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারবেন যে, ধর্ষককে ক্রসফায়ারে হত্যা করলেই সমাজে আর একটিও ধর্ষণ ঘটবে না? তাৎক্ষণিকভাবে যাকে ধর্ষক হিসেবে চিহ্নিত করা হবে তিনিই প্রকৃত অপরাধী? ধর্ষণের কয়টি ঘটনায় বিচার নিশ্চিত করা গেছে সেই দিকটিও খতিয়ে দেখা উচিত। কোন্ কোন্ বিষয় একজন মানুষকে ধর্ষণের মতো বিকৃত কর্মকাণ্ডের দিকে ঠেলে দেয় সেগুলো চিহ্নিত করার পর তা বন্ধের কোনো উদ্যোগ কি নেয়া হয়েছে? যদি না হয়ে থাকে তাহলে শুধু দু-চারজন অভিযুক্ত ধর্ষককে হত্যা করলেই এমন জঘন্য অপরাধ বন্ধ হবে কি?
দেশে দিনের পর দিন খুন, ধর্ষণ বাড়ছে। সুতরাং এ বিষয়ে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেয়া দরকার তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই ব্যবস্থা যদি ক্রসফায়ারই হতে হয় তবে আইন করে এটাকে বৈধ করতে হবে। আর সত্যি সত্যি গোটা জাতি যদি জাতীয় সংসদে আইন করে মৌলিক মানবাধিকার পদদলিত করতে চায়, আইন-আদালতকে পাশ কাটিয়ে আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার, ন্যায়বিচার, সামাজিক সমতার সংবিধান-স্বীকৃত অধিকার রদ করে মাৎস্যন্যায়ের মধ্যেই নিজের উদ্ধারের পথ খুঁজে নেয় তাতে কার কী বলার থাকতে পারে!
আমরা সংসদ সদস্যদের সংবিধানবিরোধী বক্তব্যকে স্বাগত জানাতে পারি না। এই ধরনের বক্তব্যকে রাজনীতিকদের সার্বিক ব্যর্থতারই প্রতিফলন মনে করি। এই ধরনের বক্তব্যে যে মন-মননে প্রজ্ঞার অভাব স্পষ্ট হয় তাতে আমরা শঙ্কিত বোধ করছি।

 


আরো সংবাদ



premium cement