২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
পাট ও বস্ত্র খাতের দুরবস্থা

সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে

-

পাট ও বস্ত্র খাত বাংলাদেশের শিল্পায়নের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ খাত। একসময় পাটকে বলা হতো সোনালি আঁশ। তখন পণ্যটি ছিল আমাদের রফতানি আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস। পাটের মৌসুমে প্রায় সারা দেশ ভরে থাকত সবুজ পাটক্ষেতে। পাট কাটা, জাগ দেয়া, আঁশ ছাড়ানো, আঁশ ও শোলা রোদে শুকানোর বিভিন্ন পর্যায়ের কাজগুলো ছিল গ্রামবাংলার চিরচেনা দৃশ্য। এরপর দেশজুড়ে পাট বিপণনের যে বিপুল কর্মযজ্ঞ চলত তা এক কথায় ছিল অভূতপূর্ব। এশিয়ার বৃহত্তম আদমজী জুটমিল ছাড়াও দেশে ছিল অসংখ্য ছোট-বড় পাটকল। ছিল বিপুল বেলিং কারখানা। দেশের সবচেয়ে শ্রমঘন শিল্প বলতে তখন পাটকেই বোঝাত।
পাটের সেই সুদিন আর নেই। হারিয়ে গেছে সোনালি আঁশের খ্যাতি। আর এটি ঘটেছে বিভিন্ন সময় সরকারগুলোর ভুল নীতির কারণে। দাতাগোষ্ঠীর মতলবি পরামর্শ গ্রহণ করে শিল্পায়নের এ মেরুদণ্ডটি গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে; কিন্তু পাট খাত রক্ষার কোনো বিকল্প উদ্ভাবনের দিকে মনোযোগ দেয়া হয়নি।
পাটশিল্প ধ্বংস হয়ে গেলেও পাটের গুরুত্ব কিন্তু কমেনি; বরং পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে বিশ্বজুড়ে এর ব্যবহার ও চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু অবহেলা-অব্যবস্থাপনায় মুখ থুবড়ে পড়ছে সরকারি পাটকলগুলো। একের পর এক সেগুলো বন্ধ করা হয়েছে, বিক্রি করে দেয়া হয়েছে বেসরকারি খাতে এবং শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েছেন। এ মুহূর্তে দেশের অবশিষ্ট সরকারি পাটকলগুলোতে চলছে শ্রমিক ধর্মঘট। ১১ দফা দাবিতে রাজপথে দিনের পর দিন আন্দোলন করছেন পাটকল শ্রমিকরা। পাট খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ, বকেয়া মজুরি-বেতন পরিশোধ, মজুরি কমিশন কার্যকর ও নিয়মিত মজুরি পরিশোধসহ ১১ দফা দাবিতে চলছে এই ধর্মঘট। কিন্তু এ নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না। অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোতে এখনো প্রায় ৬০ হাজার শ্রমিক কর্মরত। বেতনভাতা না পেয়ে তারা দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন।
পাটের পর আমাদের আরেকটি বড় শিল্প খাত ছিল বস্ত্র। সুদূর অতীতকাল থেকে এ দেশের মানুষের অন্যতম ঐতিহ্য ছিল বস্ত্র বয়ন। আর সেই বস্ত্রও ছিল বিশ্বসেরা। মসলিনের ঐতিহ্য এই দেশ থেকে কখনো মুছে যাবে না। জামদানি, কাতান এগুলো এখনো আমাদের বস্ত্রশিল্পের গৌরব সমুন্নত রেখেছে। তৈরী পোশাক শিল্প এখন বৃহত্তম রফতানি খাত হয়ে উঠেছে। কিন্তু এ খাতটিও এখন নানা কারণে মার খাচ্ছে। নতুন করে সমস্যা-ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এমন প্রেক্ষাপটেই সরকার এ খাতের উন্নয়নে গতকাল দেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় বস্ত্র দিবস পালন করেছে। ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বস্ত্র খাতের রফতানি ৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এই লক্ষ্যে ‘বস্ত্রনীতি-২০১৭’ এবং ‘বস্ত্র আইন-২০১৮’ প্রণয়ন করেছে। কিন্তু বিস্ময়কর ঘটনা হলো, এই দু’টি নীতিমালা তৈরিই হলো বস্ত্র খাতে বর্তমান সরকারের একমাত্র সাফল্য। এ খাতের বিকাশে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করার বাইরে কোনো রকম বাস্তব পদক্ষেপ নিয়েছে, এমনটি দেখা যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন, দীর্ঘমেয়াদি নীতির অভাব এবং সরকারের কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বস্ত্র খাত নানা সঙ্কটে জর্জরিত হয়ে পড়েছে।
তৈরী পোশাক খাতে শক্তিশালী ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প গড়ে তোলার প্রয়োজনের কথা বলা হচ্ছে দীর্ঘ দিন ধরে। প্রায় এক যুগ ধরে ক্ষমতায় থেকেও বর্তমান সরকারি দল সেই উদ্যোগ নিতে পারেনি। সম্প্রতি চীন থেকে কারখানা সরিয়ে নিচ্ছে পাশ্চাত্যের দেশগুলো। সেই কারখানাগুলো বাংলাদেশে স্থানান্তরের সুযোগও নিতে পারেনি আমাদের সরকার ও পোশাক খাত। সুযোগটি নিচ্ছে ভিয়েতনামের মতো একসময় পিছিয়ে থাকা দেশ।
আমরা মনে করি, পাট ও বস্ত্র খাত তো বটেই, অন্য শিল্পেও প্রয়োজনীয় প্রণোদনা ও সুযোগ-সুবিধা দেয়া জরুরি। তা না হলে উন্নয়নের স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই থেকে যাবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement