১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
মিয়ানমারে গণহত্যা

দোষীদের বিচার করতে হবে

-

রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর চালানো গণহত্যার অভিযোগে জাতিসঙ্ঘের সর্বোচ্চ বিচারিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস বা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে গাম্বিয়া। এই প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে কোনো মামলা হলো। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে প্রথম জেনোসাইড কনভেনশন মামলা হয়েছিল সার্বিয়ার বিরুদ্ধে ১৯৯৩ সালে। তাতে প্রমাণ হয়েছিল, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় গণহত্যা প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছিল সার্বিয়া। গাম্বিয়া ও মিয়ানমার ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ। ১৯৫৬ সালে ওই কনভেনশনে সই করে মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের গণহত্যা বিষয়ে অভিযোগ করে ৪৬ পৃষ্ঠার একটি আবেদন আন্তর্জাতিক আদালতে জমা দিয়েছে গাম্বিয়া।
মামলার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ এবং তাদের বাড়িঘর ধ্বংসের কথা বলা হয়েছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নির্মূলে রাষ্ট্রীয় গণহত্যা চালিয়েছে মিয়ানমার। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসঙ্ঘ সমর্থিত স্বাধীন আন্তর্জাতিক তথ্য অনুসন্ধানী মিশন সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, নারীদের ওপর যে যৌন সহিংসতা চালানো হয়েছে, তার প্রকৃতি এবং মাত্রা থেকেই বোঝা যায় মিয়ানমার রাষ্ট্রের ইচ্ছা ছিল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করা। গণহত্যা ঠেকানো, তদন্ত করা এবং এর শাস্তির আইন করার ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে মিয়ানমার। তবে জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক সব সংস্থার অভিযোগ অস্বীকার করে মিয়ানমার বলে আসছে, তাদের ওই লড়াই ‘সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে, কোনো জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে নয়।
যদি গাম্বিয়ার মামলাটি বিচারের জন্য গ্রহণ করা হয়, তবে এটিই হবে গণহত্যার নিজস্ব তদন্তে আইসিজের প্রথম উদ্যোগ। এর আগে তদন্তের ক্ষেত্রে তারা অন্য সংস্থার ওপর নির্ভর করত। এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আদালতে একটি আইনি প্রক্রিয়ার সূচনা করল; যেটি প্রমাণ করতে পারে যে, রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের নিষ্ঠুরতা জেনোসাইড কনভেনশন লঙ্ঘন করেছে। আইসিজের বিধি অনুসারে, জাতিসঙ্ঘের সদস্যভুক্ত এক দেশ অন্য দেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের অভিযোগ তুলতে পারে। গণহত্যা প্রতিরোধ ও এর শাস্তি বিধানে ১৯৮৪ সালে স্বাক্ষরিত কনভেনশন লঙ্ঘনের অভিযোগ করা হয়েছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। রোহিঙ্গা গণহত্যায় মিয়ানমারকে বিচারের আওতায় আনতে ১০টি সংগঠন গাম্বিয়াকে সহায়তা করছে। এখন আদালত রোহিঙ্গাদের নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচাতে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা নিতে পারেন। ১৯৯৩ সালে বসনিয়ায় গণহত্যার বিচারের শুরুতে আইসিজে সার্বিয়ার বিষয়ে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা নিয়েছিল। গাম্বিয়ার করা মামলাটি মিয়ানমারের ওপর ‘সহিংসতার পথ ত্যাগ করা এবং দোষীদের শাস্তি দেয়ার জন্য’ চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে নিরাপত্তাবাহিনীর বেশ কিছু স্থাপনায় বিদ্রোহীদের হামলার অজুহাতে রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে শুরু হয় সেনা অভিযান। তখন বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। আর আগে থেকেই বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন আরো চার লাখ। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা তাদের ওপর নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ভয়াবহ বিবরণ তুলে ধরেন; যাকে জাতিগত নির্মূল অভিযান হিসেবে আখ্যায়িত করেছে জাতিসঙ্ঘ। বিশ্বের অনেক দেশও বলেছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
লজ্জার বিষয় হলো, মিয়ানমারে গণহত্যা হলেও তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কিছুই করতে পারেনি। ওই গণহত্যার ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্যই গাম্বিয়া মামলা করেছে। অথচ কিছুকাল আগেই একনায়কতান্ত্রিক শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছে গাম্বিয়া। এমন একটি দেশ যে রোহিঙ্গা গণহত্যার ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়েছে তা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
আমরা মনে করি, গাম্বিয়ার করা মামলাটি আমলে নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে দ্রুত বিচার করাই হবে মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো; যাতে মিয়ানমারে গণহত্যায় জড়িতরা বিচারের মুখোমুখি হয়। এতে বিশ্বের প্রতিটি দেশে বার্তা যাবে, মানবতাবিরোধী অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। ফলে দেশে দেশে গণহত্যা কমে আসবে।


আরো সংবাদ



premium cement