২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
  পাহাড়ে চলছে রক্তের হোলিখেলা

‘শান্তিচুক্তি’র দু’দশক পরেও অশান্তি

-

বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের এক-দশমাংশ নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের তিনটি জেলা গঠিত। এ অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী মহলের দীর্ঘ দু’দশকের সশস্ত্র সংগ্রামের অবসানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র। কিন্তু এই ‘শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষরের দীর্ঘ ২২ বছর পরে আজ পর্যন্ত পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসেনি। বরঞ্চ চাঁদাবাজি, অপহরণ, হামলা, হত্যা, গুম প্রভৃতি অপরাধের ব্যাপকতায় পাহাড়ি-বাঙালি নির্বিশেষে সবার জীবন বিষিয়ে উঠেছে।
সহযোগী একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনটি পার্বত্য জেলায় আঞ্চলিক চারটি রাজনৈতিক সংগঠনের সহিংস ও সন্ত্রাসী অব্যাহত তৎপরতা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বসহ নানা কারণে সংগঠনগুলোর প্রশিক্ষিত ক্যাডাররা খুনোখুনির উৎসবে মেতে উঠেছে। নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি তো আছেই, এদের প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছে সাধারণ বাঙালিরাও। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলাও ঘটছে। আলোচ্য প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়, গত দু’দশকে পার্বত্য তিন জেলায় খুন হয়েছেন অন্তত এক হাজার ১০০ মানুষ। সময়ের সাথে সাথে দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি। দু’দশকে আহতের সংখ্যা কমপক্ষে এক হাজার ৪০০ জন। এ সময়ে অপহরণ করা হয়েছে প্রায় চার হাজার মানুষকে। আর মাত্র গত এক বছরে খুনের শিকার অর্ধশতাধিক।
জানা গেছে, ‘চাঁদা’ না দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন বাস করা যায় না। শুধু ব্যবসায়ী নন, সরকারি চাকুরে, এনজিও, মুদি দোকানি, সাধারণ মানুষসহ সবাই ‘চাঁদা’র নামে সন্ত্রাসীদের অর্থ দিতে বাধ্য। অর্ধবার্ষিক কিংবা বার্ষিক হারে সেই চারটি সংগঠনকে চাঁদা দিয়ে ‘কার্ড’ জোগাড় করতে হয়। কথিত চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনের অর্থ, অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করা। এমনকি, তখন খুন হয়ে যাওয়া অসম্ভব নয় মোটেও। ‘চাঁদা’র দাবিতে খুনের পাশাপাশি আধিপত্য বিস্তার, সাংগঠনিক সঙ্ঘাত এবং খুনের বদলা নেয়ার কারণেও মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকসহ ওয়াকিবহাল মহলের অভিমত, পার্বত্যাঞ্চলের আদর্শহীন কিছু সংগঠন এখন অবাধে ও বলপূর্বক চাঁদাবাজিতে লিপ্ত। তদুপরি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তারা দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষে লিপ্ত। মূলত চাঁদাবাজি বন্ধ না হলে লাশ পড়াও বন্ধ হবে না। পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার্থে ‘চিরুনি অভিযান’ শুরু করতে হবে। প্রত্যাহার করা সেনা ক্যাম্পগুলো আবার চালু করা দরকার বলেও মনে করা হচ্ছে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তদানীন্তন আওয়ামী লীগ সরকার এবং জনসংহতি সমিতির (কথিত শান্তিবাহিনীর রাজনৈতিক ফ্রন্ট) মধ্যে চুক্তির মধ্য দিয়ে দৃশ্যত সশস্ত্র সঙ্ঘাতের অবসান হয়েছিল। তবে তা ছিল অত্যন্ত সাময়িক। ওই চুক্তির বিরোধিতা করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের ( ইউপিডিএফ) আবির্ভাব ঘটেছিল। এ দিকে ক্রমেই বাড়তে থাকে পাহাড়ি জনপদে সন্ত্রাস, সংঘর্ষ ও অশান্তি। ২০১০ সালে জনসংহতি সমিতি আবার ভাঙনের শিকার হয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটে জেএসএস-এমএন অর্থাৎ ‘জনসংহতি সমিতি- মানবেন্দ্রনারায়ণ লারমা’ নামক পৃথক সংগঠনের। সর্বশেষ, ইউপিডিএফ নামের বহুলালোচিত র্যাডিকেল সংগঠনও ভেঙে গেছে এবং এর একাংশ নিয়ে গঠিত হয়েছে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। সব ক’টি সংগঠন পার্বত্য তিন জেলায় নানাভাবে তৎপর রয়েছে।
স্মর্তব্য, ২০০১ সালে তিন বিদেশী নাগরিকের অপহরণের মাধ্যমে পাহাড়ি জনপদে চুক্তি-পরবর্তী অপরাজনীতির ধারা বিশেষভাবে সূচিত হয়েছিল। এরপর দিনে দিনে খুন, গুম, অপহরণ, হামলা, চাঁদাবাজি, আধিপত্য প্রয়াস প্রভৃতি মিলে সহিংসতার রকমারি তাণ্ডব যেন নিত্যকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাহাড়ি-বাঙালি নির্বিশেষে মানুষ আজ অব্যাহত সন্ত্রাস-সহিংসতায় অতিষ্ঠ। এ অবস্থার স্থায়ী অবসান ঘটাতে কঠোর হস্তে সব ধরনের সন্ত্রাস-সহিংসতা ও চাঁদাবাজি দমন এবং দলমত নির্বিশেষে সবার সব বেআইনি অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। বাঙালি ও পাহাড়ি, উভয়ের শান্তিপূর্ণ ও সম্প্রীতিময় সহাবস্থানের স্বার্থে, বিচ্ছিন্নতাবাদী ও আঞ্চলিকতা মানসিকতার মূলোৎপাদন এবং সংশ্লিষ্ট সর্বপ্রকার দেশী-বিদেশী চক্রান্ত নির্মূল করার বিকল্প নেই। এ দেশের অবিচ্ছেদ্য এই বিশাল ভূখণ্ডের প্রতিটি নাগরিকের সব গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সেখানকার পুরো জনজীবনে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের এবং সরকারের সার্বিক কল্যাণকামিতার প্রতিফলন থাকা চাই।

 


আরো সংবাদ



premium cement