১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
মানবপাচার বন্ধ হচ্ছে না

আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে

-

সংসারের অভাব থেকে মুক্তি পেতে বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জনৈকা গৃহবধূ। তার স্বামী কাজ করতে অক্ষম। এই নারী সংসারের জন্য আয় করার উদ্দেশ্যে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে দেশ ছাড়লেন। কিন্তু তাকে লেবাননের কথা বলে যুদ্ধবিগ্রহপূর্ণ সিরিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। অথচ তিনি লেবানন যাওয়ার জন্যই সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সিকে দিয়েছেন ৯০ হাজার টাকা। সে দেশে নেয়া হচ্ছে জেনেই উঠেছিলেন উড়োজাহাজে। তবে বিমান থেকে নামার কিছু সময় পরে বুঝতে পারলেন, তাকে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় নেয়া হয়েছে। সর্বোপরি, সেখানে ঘৃণ্যতম পেশার ‘যৌনকর্মী’ হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয় এই সরল ও অসহায় পল্লীবধূকে। এর পর একনাগাড়ে ৯টি মাস ধরে তিনি ওই দেশে হয়েছেন অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার। অবস্থা এতটা চরমে পৌঁছে যে, তিনি হাঁটার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেন। অবশেষে র্যাবের সহায়তায় দেশে ফিরে এসেছেন। এর আগেই র্যাব এ ঘটনায় জড়িত রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, সেই প্রতারক এজেন্সির বিরুদ্ধে ‘অপেক্ষাকৃত কঠোর’ মানবপাচার আইনে মামলা না নিতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় চিঠি পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। একজন নিরীহ নির্দোষ গৃহবধূর জীবন ধ্বংস করে দেয়ার মাধ্যমে কিভাবে প্রবাসীর ‘কল্যাণ’ করা হয় এবং প্রতারণা ও মিথ্যাচারের মধ্য দিয়ে জঘন্যতম পেশায় নিয়োজিত হতে কাউকে বাধ্য করাকে ‘কর্মসংস্থান’ বলা যায় কি না, সে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া জাতির জন্য জরুরি।
একটি জাতীয় দৈনিকের সচিত্র লিড নিউজে প্রসঙ্গক্রমে আরো জানানো হয়েছে, র্যাব যখন অবৈধ মানবপাচার এবং বিদেশে কর্মসংস্থানের নামে প্রতারণা দমনে তৎপর হয়ে উঠেছে, তখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অদ্ভুত অভিযোগ করে বলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারণে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর ‘ক্ষতি’ হচ্ছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, যেখানে মানবপাচারের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, সেখানে অভিবাসন আইনে সর্বোচ্চ মাত্রার শাস্তি হলো পাঁচ বছর কারাদণ্ড। এ দিকে, আলোচ্য মামলা দায়েরের পর পাঁচটি বছর পার হয়ে যাওয়ায় উল্লিখিত গৃহবধূ সুবিচারের আর প্রত্যাশা করেন না।
ওয়াকিবহাল মহলের বক্তব্য, মানবপাচারকে ঘৃণ্যতম অপরাধ হিসেবে প্রায়ই প্রচার করা হলেও খোদ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ওই মনোভাব হতাশাজনক। অপর দিকে, মানবপাচার রোধে ‘সর্বোচ্চ নজরদারি’র কথা বলা হলেও তার প্রয়োগ না হওয়ায় সাত বছর আগে তৈরি করা সংশ্লিষ্ট আইন ‘কাজীর গরু’র পরিণতি লাভ করেছে। এই প্রেক্ষাপটে, দুর্গম পথে বিদেশযাত্রা সত্ত্বেও মানবপাচারের মতো অপরাধ বেপরোয়াভাবে চলছে। এ ক্ষেত্রে দুর্বল নজরদারির সাথে যোগ হয়েছে বিচারে দীর্ঘসূত্রতা তথা একপ্রকার বিচারহীনতা। মানবপাচার আইনে এযাবৎ মামলার সংখ্যা চার হাজার ৬৬৮। নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২৪৫টির। জানা গেছে, নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে ‘আপসরফা’র ঘটনাই বেশি। অন্যগুলোর বিাচর বিলম্বিত হচ্ছে, যদিও আইনে নির্দেশ আছে, ৯০ দিনের মধ্যে অভিযোগ গঠন করে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচারকার্য সম্পন্ন করতে হবে। বিলম্বের সুযোগে আসামিরা জামিনে বেরিয়ে এসে আবার মানবপাচারে লিপ্ত হয়। এ অবস্থা চলতে দিলে পরিস্থিতির কেবল অবনতিই ঘটবে।
জানা যায়, গত মে মাসে ভূমধ্যসাগর দিয়ে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে ৩৭ জন বাংলাদেশীর সলিল সমাধি ঘটেছে। এর মাত্র এক মাসের মধ্যে একই সাগরে ভাসমান ৬৪ বাংলাদেশী নাগরিককে তিউনিসীয় উপকূল থেকে উদ্ধার করা হয়। সাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশে কাজ করতে যাওয়ার পথে নৌযান ডুবে এযাবৎ অন্তত কয়েক শ’ বাংলাদেশীর মৃত্যু ঘটেছে। অন্য দিকে, কেবল ভারতেই বছরে অর্ধলক্ষ নারী এ দেশ থেকে পাচার করা হচ্ছে বলে বিএসএফ জানিয়েছে। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য শ্রমবাজারের সুষ্ঠু বিস্তার এ অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে বলে অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে।
আমরা মনে করি, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের জন্য শ্রমবাজারের কাক্সিক্ষত বিকাশের জন্য সর্বাত্মক প্রয়াসের পাশাপাশি মানবপাচার স্থায়ীভাবে বন্ধ করার উদ্দেশ্যে সরকারকে কঠোর হতে হবে। সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের সমন্বয় ও দায়িত্ববোধ সর্বোপরি কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি।


আরো সংবাদ



premium cement