২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না

দুর্নীতির মূলোৎপাটন সরকারেরই দায়িত্ব

-

বাংলাদেশ আগে বিশ্বে পরিচিত ছিল প্রধানত দুর্যোগ ও দারিদ্র্যের দেশ হিসেবে। গত কয়েক দশকে এ দেশ ব্যাপক দুর্নীতির কারণেও বিশ্বে আলোচিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বারবার ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন’ হয়েছে আমাদের দেশ, যা জাতির জন্য নিদারুণ লজ্জাকর। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দৃশ্যত বেশ কিছুটা উন্নয়ন হয়েছে এবং বাংলাদেশ কয়েকটি বিষয়ে অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে প্রশাসন ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির মাত্রা না কমে, বরং বাড়ছে বলেই প্রতীয়মান। আর ভূমিসংক্রান্ত প্রশাসনকি কাজকর্ম যে, দুর্নীতির একটা ‘ঐতিহ্যবাহী’ লালনক্ষেত্র, তা সবার জানা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এবার ভূমি ক্রয় ও নিবন্ধনের ব্যাপারে সংঘটিত দুর্নীতির বিশাল বহর নিয়ে গবেষণা করে এর ওপর রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। পত্রপত্রিকার এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে জানা যায়, ঘুষ ছাড়া দেশের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসগুলোতে কাজ করা হয় না। একজন সাব-রেজিস্ট্রার অনিয়মের মাধ্যমে বদলি হতে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ‘লেনদেন’ চলে। এ ক্ষেত্রে এলাকাভেদে সর্বনিম্ন তিন লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়; তবে রাজধানী কিংবা আশপাশে বদলি হওয়ার জন্য অর্ধকোটি টাকারও ‘বিনিময়’ হয়ে থাকে।
টিআইবির প্রাসঙ্গিক জরিপে ভূমি প্রশাসনক্ষেত্রে সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপের মধ্যে নিবন্ধন সেবাসংক্রান্ত আইন ও বিধি সংশোধন ও হালনাগাদ করা এবং ফি ও শুল্ক পে-অর্ডারে শোধ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সাথে সাথে জানিয়ে দেয়া হয়, আইনগত, পদ্ধতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা এবং জবাবদিহি ও সমন্বয়ের ঘাটতির কারণে এ খাতে সুশাসন কায়েম হয়নি। এ প্রেক্ষাপটে ভূমি নিবন্ধন সেবার যুগোপযোগী মানোন্নয়নের স্বার্থে ১৫ দফা সুপারিশ পেশ করেছে টিআইবি।
বেসরকারি সংস্থাটির গবেষণায় দেখা গেছে, ভূমির দলিল নিবন্ধনে প্রতারণা, দায়িত্বে গাফিলতি, রাজনৈতিক ও অন্যবিধ অবাঞ্ছিত প্রভাব বিস্তার, অহেতুক বিলম্ব ঘটানো প্রভৃতির মাধ্যমে ‘ফাঁদে ফেলে’ দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়ম দ্বারা অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ে ঘুষ ছাড়া কাজ করানো খুব কঠিন। দলিল লেখার ফি সম্পর্কে সেবাগ্রহীতাদের জ্ঞানের অভাবের সুযোগ নিয়ে, দলিলের দাম ও নিবন্ধনের ধরনের ওপর ভিত্তি করে দলিল লেখকেরা প্রতি লাখে ৩ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত নিচ্ছেন। তদুপরি, নিবন্ধন করাতে হলে প্রত্যেক দলিলের জন্য দলিল লেখক সমিতির চাঁদা বাবদ অবৈধভাবে অর্থ দিতে বাধ্য করা হয়। টিআইবির অনুসন্ধানে জানা যায়, দলিল নিবন্ধনের জন্য পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থ নিয়মবহির্ভূতভাবে আদায় করা হচ্ছে। এমনকি, ‘অফিস খরচ’ নাম দিয়েও অবৈধ পন্থায় অর্থ নেয়া হয় সেবাগ্রহীতাদের থেকে। দলিলের নকল উত্তোলনের জন্য নির্ধারিত ফি’র বাইরে এক থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। ঘুষ বা অবৈধ অর্থের লেনদেনের জন্য সংশ্লিষ্ট লোকজনের সাধারণত যোগসাজশ থাকে। সাধারণ মানুষকে অসহায় করে দুর্নীতির শিকারে পরিণত করা হয়।
দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ যেমন কোনো দিন প্রকৃত উন্নয়ন অর্জন করতে পারে না, তেমনি দুর্নীতিপরায়ণ জাতি কখনো আসলে সুসভ্য বলে নিজেকে দাবি করতে সক্ষম হয় না। দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি পেলে বাংলাদেশ আরো অনেক সাফল্য অর্জন করে বহু গুণ উন্নত হতে পারত। দুর্নীতি অব্যাহত থাকলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না; আর সুশাসন ছাড়া গণতন্ত্র অর্থহীন। দুর্নীতির প্রকোপ বর্তমান সরকারের ‘ডিজিটাল দেশ’ গড়ার উদ্যোগেরও একটা বিরাট অন্তরায়।
নাগরিকদের বা জনগণের অধিকার কায়েম, রাষ্ট্রীয় অর্থের সদ্ব্যবহার এবং উন্নয়নকে ফলপ্রসূ করার স্বার্থে অবিলম্বে রেজিস্ট্রি অফিসসহ সব ধরনের দুর্নীতির স্থায়ী মূলোচ্ছেদ করা জরুরি। আর এটা প্রধানত প্রশাসন বা সরকারের একটা বড় দায়িত্ব।


আরো সংবাদ



premium cement