২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
৮৭ কোটি টাকা চাঁদাবাজি প্রতি বছর

ধরতে হবে গডফাদারদের

-

বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ২১৫টি সংস্থা ও সংগঠন মহাসড়কগুলোতে চলাচলকারী ৫৮ হাজার ৭১৯টি যানবাহন থেকে দিনে গড়ে ২৪ লাখ টাকার চাঁদা তুলছে। এ হিসাবে বছরে ‘চাঁদা’ দিতে হয় ৮৭ কোটি টাকা। শুধু মহাসড়কেই যদি এ অবস্থা চলে, তাহলে সহজেই অনুমান করা যায়, ১৬ কোটি মানুষের এ দেশে বিভিন্ন সমিতি-সংগঠন, এমনকি অনেক ব্যক্তির নামে প্রতিদিন কী বিপুল পরিমাণ অর্থ চাঁদা হিসেবে তোলা হচ্ছে। মহাসড়কে এই কালো টাকা সংগ্রহ, তথা চাঁদাবাজির চিত্রটি উপস্থাপিত হয়েছে হাইওয়ে পুলিশের বার্ষিক প্রশাসনিক প্রতিবেদনে। একটি জাতীয় দৈনিক খবরটি ছাপিয়েছে গুরুত্ব দিয়ে।
হাইওয়ে পুলিশের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেশের সড়কে বাস-ট্রাক থেকে তোলা চাঁদার পরিমাণ প্রকৃতপক্ষে ১০০ কোটি টাকারও বেশি। কারণ, আনুমানিক ৮৭ কোটি টাকার উল্লিখিত হিসাবে শুধু মহাসড়ক ধরা হয়েছে, তবে আঞ্চলিক কিংবা জেলা উপজেলা সড়কগুলো এর অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
পত্রিকাটির আলোচ্য প্রতিবেদনের শুরুতে বলা হেেছ, ‘দেশের বিভিন্ন মহাসড়ক ও বাস-ট্রাক টার্মিনালে চাঁদাবাজি গোপন কিংবা নতুন কিছু নয়। সবই হয় প্রকাশ্যে এবং নিবন্ধিত সংগঠনের নামে। বছরে মহাসড়ক থেকে কত টাকা চাঁদা আদায় হয়, সেই তথ্য সুনির্দিষ্টভাবে কারো কাছে নেই।’ এতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, এই চাঁদার টাকায় গোপনে পকেট ভারী হয় পুলিশ এবং পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের প্রভাবশালী নেতাদের। রাজনৈতিক কিছু নেতাও পান এর ভাগ। পরিবহন শ্রমিক ও মালিকদের অনেকেই বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে তারা নাম উদ্ধৃত করে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করে ‘ঝামেলায় পড়তে চাননি’। তারা জানান, পণ্যবাহী যানে চাঁদাবাজি চলছে বেশি। ঈদের সময় তা বেড়ে যায় বহু গুণ। এর একটি বড় অংশ পুলিশের কাছে চলে যায়। তাদের মধ্যে হাইওয়ে এবং থানা উভয় পুলিশ রয়েছে। অন্য দিকে, বাসের চাঁদাবাজিতে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের প্রাধান্য বিদ্যমান। এদিকে, পুলিশের নজর বেশি স্বল্প দূরত্বের যানের দিকে। পরিবহন মালিকদের অভিযোগ, বিশেষত যারা ব্যাংকের ঋণে বাস-ট্রাক কিনেছেন, তারা ব্যাংকের টাকা পরিশোধে সমস্যায় পড়ছেন। কারণ, বিভিন্ন নামে যে চাঁদাবাজি করা হয়, এ জন্য তাদের অনেক টাকা দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তিনি বলেছেন, চাঁদাবাজির বহু অভিযোগ আসে আমাদের কাছে। প্রশাসনের দায়িত্ব এটা বন্ধ করা।
আলোচ্য পত্রিকাটির প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়, রাজধানীর তিনটি প্রধান টার্মিনাল থেকে দিনে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার বাস ছেড়ে যায়। চাঁদা না দিয়ে কোনো বাসই টার্মিনাল থেকে বের হতে পারে না। বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতে, শুধু গাবতলী থেকেই দৈনিক চার হাজার বাস দেশের নানা স্থানের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। গাবতলী টার্মিনাল পুলিশ ফাঁড়ির পাশেই চাঁদা আদায় করার বুথ। ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন প্রধান জানিয়েছেন, টার্মিনাল ছেড়ে যাওয়ার সময় প্রত্যেক বাসকে মালিক সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন এবং পার্কিং ফি বাবদ ৪০ টাকা করে ১২০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। আর সড়কে যেখানেই যাত্রী ওঠানামা করা হয়, সেখানে ৫০ টাকা করে দিতে হয় মালিক-শ্রমিক সংগঠনকে। মহাখালী টার্মিনাল থেকে দিনে গড়ে ৬০০ যান যাত্রী নিয়ে ছেড়ে যায়। প্রতিটি বাসকে পার্কিং, মালিক-শ্রমিক সমিতি এবং কল্যাণ তহবিল বাবদ যথাক্রমে ৪০ টাকা, ১১০ টাকা এবং ২০ টাকা করে দিতে হচ্ছে। এখানকার মালিক সমিতির সভাপতির বক্তব্য, প্রতি রুটেই ২০-২৫ স্থানে মাসিক চাঁদা দিতে হয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে জানা গেছে, নেত্রকোনা রুটে পুলিশকে ২০০ টাকা করে ‘চাঁদা’ দিতে হয় একেকটি বাসকে। সায়েদাবাদ থেকে প্রতিদিন ছাড়ে এক হাজার ২০০ বাস। টার্মিনাল ত্যাগের সময় মালিক সমিতিকে ৪০ টাকা এবং শ্রমিক সংগঠনকে ৩০ টাকা করে দিতে হয়। ‘স্থানীয় থানাকে এ টার্মিনাল থেকে মাসে গড়ে ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকা দিতে হয়’, বলেছেন একটি পরিবহন কোম্পানির কর্মকর্তা।
আমরা মনে করি, অবৈধ আয় বন্ধ করা এবং পরিবহন খাতে নৈরাজ্যরোধ ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, তথা বৃহত্তর জনস্বার্থেই অবিলম্বে সড়ক, মহাসড়ক ও পরিবহন টার্মিনালসহ দেশের সর্বত্র চাঁদাবাজি বন্ধ করা উচিত কঠোরহস্তে। এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে সংশ্লিষ্ট ‘গডফাদারদের’ বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা দিতে হবে। সেই সাথে বন্ধ করতে হবে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং যেকোনো মহলের দৌরাত্ম্য।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement