২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`
ভিআইপি প্রটোকল দিতে গিয়ে ছাত্রের মৃত্যু

‘বিশিষ্ট’ হওয়ার এমন মানসিকতা কেন?

-

প্রায় সবার মধ্যে ‘বিশিষ্ট’ হওয়ার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এটা জোর জবরদস্তির পর্যায়ে চলে না গেলে খুব একটা দোষের নয়। সমস্যা হলো, সবাই নিজের বিশিষ্ট হওয়ার সুযোগের ফায়দা নিতে চান। বিশেষ করে রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে ঘোষণা দিয়ে এমন সুযোগ নেয়া হয়। অন্ততপক্ষে গাড়িতে পরিচয় সাঁটিয়ে দিয়ে এমন সুযোগ নিতে দেখা যায়। যেমন, গাড়িতে যখন ‘সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী’ কথাটি লেখা থাকে তখন সেটি রাস্তায় চলাচলে একটা বিশেষ সুযোগ পেয়ে থাকে। শুধু আইনজীবী নন, এ পরিচিতি ব্যবহার করেন ডাক্তার, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অনেকেই। ফলে সাধারণ মানুষের বৈধ সুবিধাও কমে যায়। এই বিপুল মানুষ হচ্ছেন ক্ষমতাহীন, তারা রাস্তায় বিশিষ্টদের দাবড়ানির শিকার হন নানাভাবে। মাদারীপুরে একটি ফেরিঘাটে এমন অবৈধ ক্ষমতার দাপটে এক স্কুলছাত্র চিকিৎসা সুবিধাবঞ্চিত অবস্থায় প্রাণ হারাল।
সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি এক নম্বর ফেরিঘাটে দাঁড়ানো ফেরিতে উঠেছিল। কিন্তু ফেরিটি দীর্ঘ তিন ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করে এক যুগ্ম সচিবের জন্য। তিনি ফেরিতে পৌঁছলে কেবল তখনই সেটি ছাড়ে। ফেরি মাঝনদীতে পৌঁছলে তিতাস মস্তিষ্কের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যায়। আগের তিন ঘণ্টায় তিতাসের স্বজনেরা কর্মকর্তাদের কাছে অনেক অনুনয়-বিনয় জানিয়ে ফেরি ছাড়ার আবেদন করেও কোনো সাড়া পাননি। ফেরি কর্তৃপক্ষকে তার আগে জেলা প্রশাসক জরুরি বার্তা দিয়ে জানিয়ে রেখেছিলেন, ওই যুগ্ম সচিবের গাড়ি না পৌঁছা পর্যন্ত ফেরি ছাড়া যাবে না। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যখন একটি নির্দেশ দেবেন, সেটি কতটা আইনসঙ্গত তা তাদের দেখতে হবে। মহাসড়কে শুধু সাধারণ ও সুস্থ যাত্রীরা চলাচল করেন না। সেখানে প্রতিদিন অসংখ্য রোগী, এমনকি তিতাসের মতো মুমূর্ষুদেরও আনানেয়া করা হয়। যত দ্রুত তারা হাসপাতালে পৌঁছতে পারেন ততই বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি। ব্যাপারটি একজন জেলা প্রশাসকের জানা না থাকার কথা নয়।
একজন যুগ্ম সচিবের জন্য তিন ঘণ্টা একটি ব্যস্ত ফেরি আটকে রাখলে দেশের যোগাযোগব্যবস্থা থমকে যাওয়ার কথা। যুগ্মসচিব পদমর্যাদার সরকারি কর্মকর্তার দেশে অভাব নেই। আধা সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তাকে এ শ্রেণীতে বিবেচনা করা হলে তাদের ‘অসংখ্য’ বলা যায়। যা হোক, তিতাস ঘোষের মৃত্যুর পর এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের বিচারক মন্তব্য করেছেন, দেশে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কোনো ভিআইপি নেই। রাস্তায় যে ভিআইপির কারণে ফেরিতে স্কুলছাত্রের প্রাণ গেছে, তিনি জনগণের সেবক। তার সচেষ্ট হওয়ার কথা ছিল জনসেবায়। ব্যাপারটা উল্টো হয়ে দেখা যাচ্ছে যুগ্ম সচিবের ‘সেবা’ করতে গিয়ে প্রজাতন্ত্রের নাগরিকেরা প্রাণ দিচ্ছেন।
রাষ্ট্রের নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। বলা হয়ে থাকে, ‘জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস’। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের সেবায় নিযুক্ত থাকাই দায়িত্ব। বাস্তবে আমাদের দেশে ঘটছে তার বিপরীত। এখানে ‘জনগণ’ ক্ষমতাহীন। তারা সরকার ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সেবা করতে বাধ্য হচ্ছেন। বিশেষ করে সরকার বা রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে জড়িত থাকার সুযোগ নিয়ে অনেকে একপ্রকার প্রভু হয়ে উঠছেন। এই হীনপ্রবণতা ক্রমবর্ধমান। প্রকৃতপক্ষে জনসেবা করতে হলে রাষ্ট্রের এই চরিত্র বদলাতে হবেই। তিতাসের মৃত্যু নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠিত হচ্ছে। আমরা এই ঘটনার উপযুক্ত বিচার চাই। মনে রাখতে হবে, কেবল একটি ঘটনার প্রতিকার ‘বিশিষ্ট’ হওয়ার অপসংস্কৃতির পরিবর্তন আনবে না। এ জন্য দরকার রাষ্ট্র পরিচালকদের মনোভাবের আমূল পরিবর্তন।


আরো সংবাদ



premium cement