২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
সাংস্কৃতিক খাতে বরাদ্দ কমানো

সরকার কি সংস্কৃতির সঙ্কোচন চায়?

-

সংস্কৃতির প্রতি সরকার কতটা উদাসীন তা বোঝা যায় এই খাতে প্রতি বছরের বাজেট বরাদ্দের হার দেখলেই। গত বছর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেট বরাদ্দ ছিল মাত্র ৬২৫ কোটি টাকা। আর সম্প্রতি ঘোষিত প্রস্তাবিত বাজেটে দেয়া হয়েছে ৫৭৫ কোটি টাকা। গত বছরের চেয়েও ৫০ কোটি টাকা কম। এই নিয়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এবার কিছুটা অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে। গান-বাজনা, নাটক-সিনেমানির্ভর সংস্কৃতির পুরোধা ব্যক্তিরা প্রায় সবাই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সংবাদ সম্মেলন করে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে এবং কম বরাদ্দের প্রতিবাদে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন স্থানে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো নানাভাবে তাদের ক্ষোভের কথা তুলে ধরছে।
আমরা জানি, বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলটি রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য সব সময়ই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে গুরুত্ব দিয়েছে। সেটা সব সময় ইতিবাচক অর্থে করেছে এমন নয়, বরং রাজনীতির অন্য সব হাতিয়ারের মতো সাংস্কৃতিক কর্মীদেরও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯৯৫ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলনে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে দীর্ঘ মাস ধরে যে জনতার মঞ্চ সক্রিয় ছিল, সেটি এমনই একটি উদাহরণ মাত্র। এভাবে বিভিন্ন সময় সাংস্কৃতিক শীর্ষ ব্যক্তিরা নানাভাবে দলটির রাজনৈতিক লাঠি হিসেবে ব্যবহার হয়েছেন। তাই সাংস্কৃতিক খাতের বরাদ্দ কমে গেলে তাদের ক্ষুব্ধ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কারণ, সংস্কৃতি ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমেই কিছু সৌভাগ্য গড়িয়ে আসে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের পকেট পর্যন্ত।
তবে এটি বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে, সমাজ জীবনে সংস্কৃতির একটি বৃহত্তর ভূমিকা রয়েছে। সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা মানুষের মননকে পরিশীলিত করে, তার চিন্তাচেতনার বিকাশ ঘটায় এবং উন্নত জাতি গঠনে সহায়ক হয়। সংস্কৃতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে সেই বিবেচনা থেকে। বর্তমান বাংলাদেশে সুস্থ মননচর্চা প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। নাটক-সিনেমার ক্ষেত্রে যেমন, সৃজনশীল কাব্য, সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রেও তেমনই। উদার গণতান্ত্রিক সমাজ-কাঠামো ভেঙে দিয়ে যে একক ও সর্বাত্মক শাসনের সংস্কৃতি চালু করা হয়েছে তাতে আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক সব অঙ্গনের মতোই সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও ছড়িয়ে পড়েছে এক সর্বব্যাপী বন্ধ্যত্ব।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদী প্রবণতার উত্থান একটি চরম বাস্তবতা। যুবকদের চরমভাবাপন্ন হয়ে ওঠা প্রতিরোধের উপায় কিন্তু নিহিত রয়েছে একমাত্র সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্যেই। একটি আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, মননশীল সমাজ গড়ে তোলার জন্য সংস্কৃতির প্রসার ঘটতে দিতে হবে। আমাদের ধারণা, এ বিষয়ে দ্বিমত করার কোনো অবকাশ নেই। ন্যায়ভিত্তিক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সারা দেশে একটি সাংস্কৃতিক জাগরণ সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তাও সর্বস্বীকৃত একটি বিষয়। তাহলে সাংস্কৃতিক খাতের জন্য বাজেট বরাদ্দ কম দেয়া হয় কোন যুক্তিতে? গত বছরের চেয়ে এবার বাজেটের আকার বেড়েছে, মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি বেড়েছে এবং চরমপন্থা প্রতিরোধের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ নতুন সামাজিক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিত যদি জাতীয় বাজেট প্রণয়নের সময় সরকারের বিবেচনায় না থাকে, তাহলে সেটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যের বিষয় ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা মনে করি, বাজেটের কমপক্ষে ১ শতাংশ সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দের যে দাবি উঠেছে, তা মোটেই অযৗক্তিক নয়।
অভিযোগ আছে, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তাদের জন্য বরাদ্দের পুরো টাকা অনেক সময়ই খরচ করতে পারে না। সেটা সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক ব্যর্থতা। প্রায়ই এখানে এমন সব রাজনৈতিক ব্যক্তিকে মন্ত্রী নিয়োগ দেয়া হয়, যার হয়তো কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠন চালানোর যোগ্যতাও নেই।
যা হোক, আমরা আশা করব সংস্কৃতি সঙ্কোচনের নীতি বর্জন করে সরকার শুভবুদ্ধির পরিচয় দেবে। সারা দেশের সাংস্কৃতিক কর্মীদের মতো আমাদেরও আশা, প্রস্তাবিত বাজেট সংশোধন করে সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ বাড়াবে সরকার।

 


আরো সংবাদ



premium cement