২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
ক্রাইস্টচার্চে শান্তির বারতা

বিশ্ববাসীর জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত

-

ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে ব্যক্তি থেকে বৈশ্বিক জীবনে কখনো শান্তি আসেনি, সম্ভবও নয়। এটিই শাশ্বত সত্য। ইদানীং বিশেষত, পশ্চিমের দেশে দেশে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা চরমে পৌঁছেছে। এর সর্বশেষ জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত শান্তির তালিকায় বিশ্বসূচকে দ্বিতীয় স্থানে থাকা দেশ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে ১৫ মার্চ ব্রেন্টন হ্যারিসন ট্যারান্ট নামে এক শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীর নির্বিচার গুলিতে নারী ও শিশুসহ ৫০ জন নিহত হওয়ার ঘটনা। মসজিদে জুমার নামাজ আদায়রত মুসল্লিদের ওপর বর্ণবিদ্বেষী ও সাম্প্রদায়িক এই নারকীয় হামলা থেকে তিন বছর বয়সী দুধের শিশুও রেহাই পায়নি। মর্মান্তিক এ ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন, তাদের স্মরণে গত শুক্রবার সে মসজিদসংলগ্ন পার্কে সমবেত হন হাজার হাজার মানুষ। সেখানকার সমাবেশে নারীরা সবাই মাথায় পরেছিলেন মুসলিম ঐতিহ্যবাহী পোশাক স্কার্ফ। অনেকের চোখে ছিল বেদনার অশ্রু। স্বেচ্ছাসেবী এবং পুলিশ সদস্যরাও সংহতির বাইরে ছিলেন না। এক নারী পুলিশ তো রীতিমতো হাতে অস্ত্র, মাথায় স্কার্ফ আর বুকে লাল গোলাপ নিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। সত্যিই এমন সংহতি পাশ্চাত্যে বিরল, যা নিউজিল্যান্ডে দেখল দুনিয়াবাসী।
আধুনিক নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা ১৫ মার্চের ঘটনা। দুনিয়ায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর এমন হামলা নিকট অতীতে আর হয়নি। এ হামলার পর থেকে নিউজিল্যান্ড দেখিয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এরই ধারাবাহিকতায় ২২ মার্চ দিনটিকে বেছে নেয়া হয় মুসলিমদের প্রতি সমবেদনা ও সহমর্মিতা প্রকাশের জন্য। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতা জানাতে সমবেত হন ঘটনাস্থল, আল নূর মসজিদের নিকটবর্তী হেগলি পার্কে ২০ হাজার মানুষ।
নীরবতা কখনো কখনো মারণাস্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। নীরবতার প্রচণ্ড আঘাতে সন্ত্রাস, চরমপন্থা, বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে পরাভূত করতে পুরো নিউজিল্যান্ড শুক্রবার দুই মিনিট নির্বাক কাটিয়েছে। যেন ভরদুপুরে নেমে আসে মধ্যরাতের স্তব্ধতা। সেই নিস্তব্ধতায় ছিল মহাসাগরের তীব্র গর্জন। নীরবতার মাধ্যমে তুলে ধরা হয় শান্তি, ঐক্য ও সংহতির মানবতাবাদী অবিনাশী বারতা। ইতিহাসকে পথ দেখিয়ে খ্রিষ্টানপ্রধান দেশটির রাষ্ট্রীয় টিভিতে ধ্বনিত হয় আজানের সুমধুর পবিত্র ধ্বনি। নামাজের জামাতও সরাসরি সম্প্রচার করা হয় সরকারি প্রচারমাধ্যমে। মুসলিমদের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে ছুটে আসেন দেশটির অমুসলিম নাগরিকেরা। তাদের মধ্যে উপস্থিত হয়ে দ্যুতি ছড়িয়েছেন প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন। ইমামের খুতবার আগে সংক্ষিপ্ত কিন্তু হৃদয়গ্রাহী ভাষণ দেন তিনি। পার্কে উপস্থিত মুসলিম-অমুসলিম জনতার উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পুরো নিউজিল্যান্ড আপনাদের সাথে কাঁদছে। আমরা অভিন্ন।’ একটি হাদিস তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘মুহাম্মদ সা:-এর মতে দয়া, সমবেদনা ও সহমর্মিতায় বিশ্বাসীরা একটি দেহের মতোই। যখন শরীরের একটি অঙ্গ কষ্ট পায়, তখন পুরো শরীরেই যন্ত্রণা হয়।’ হিজাব পরিহিত আরডার্ন প্রায় আধা ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করেন। তার রাষ্ট্রনায়কোচিত এ ভূমিকা মুসলিম-অমুসলিম সবার প্রশংসা কুড়ালেও কিছু লোক যে এতে ক্ষুব্ধ হয়েছে, তা স্পষ্ট। সোস্যাল মিডিয়ায় তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে।
উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক বিশ্বের হোতাদের মনে রাখতে হবে, ভালোবাসার জাদুর কাঠিতেই কেবল বিশ্বমানবতার জয় হতে পারে। হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে কেউ শান্তির সুবাতাস বইয়ে দিতে পারেনি। এতে হানাহানি বেড়েছে বৈ কমেনি। তাই বিশ্বকে মানুষের বাসযোগ্য, শান্তিময় করতে সহাবস্থান ও সহনশীলতার বিকল্প নেই। সবাইকে মনে রাখতে হবে, স্রষ্টার সৃষ্টি সব মানুষ সমান। সবাইকে শান্তিময় বিশ্ব গড়তে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে বিশ্বমানবতার কল্যাণ।


আরো সংবাদ



premium cement