২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`
মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আজ

ভাষাশহীদের রক্তের মর্যাদা দিতে হবে

-

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের অনন্য নজির একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের এই দিনে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল রফিক, বরকত, সালাম, জব্বার প্রমুখের তাজা রক্তে। তাদের রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষা তার যথাযোগ্য মর্যাদা পেয়েছে। বর্তমানে একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশের মতো বিশ্বের অনেক দেশেই আজ গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় দিনটি উদযাপন করা হচ্ছে।
প্রায় সাত দশক আগে ইতিহাসের সেই পাতাগুলোতে চোখ বুলালে আমরা দেখতে পাই, তমদ্দুন মজলিস নামে একটি নবগঠিত সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যানারে কিভাবে বাংলাভাষী মানুষেরা প্রথমে সংগঠিত হচ্ছিল। সংগঠনটি সদ্যপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে মর্যাদা দেয়ার দাবি তোলে। এ দাবির পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ প্রথম কাতারের বুদ্ধিজীবীরা। ১৯৪৮ সালের মধ্যেই তারা রাষ্ট্রভাষার দাবি জনপ্রিয় করে তুলতে সক্ষম হন। ১৯৫২ সালের প্রথম দিকে এটি এ অঞ্চলে ছাত্র-জনতার প্রধান দাবিতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এই দাবির গভীরতা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়। তাই তারা বিষয়টিকে সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে শুরু করে এবং গণমানুষের প্রাণের দাবি অস্ত্রের ভাষায় দাবিয়ে রাখার হঠকারিতা দেখায়। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের মিছিলে বাধা দিয়ে ১৪৪ ধারা জারি করে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করার ব্যর্থ চেষ্টা চালানো হয়। পুলিশের গুলিতে রাজপথ রঞ্জিত হলো। দিনটি ছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, তখনকার বর্ষপঞ্জি মোতাবেক ৮ ফাল্গুন।
কেন্দ্রীয় শাসকেরা উর্দুকে বাঙালিদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এ ক্ষেত্রে তারা বাস্তবতা বিবেচনা করেননি বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। কারণ, উর্দু দেশের কোনো প্রদেশের ভাষা ছিল না। অপর দিকে, বাংলা ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা। তদানীন্তন পাকিস্তানে প্রচলিত ভাষাগুলোর মধ্যে প্রায় সব বিবেচনায় এটি ছিল অগ্রগণ্য। তাই বাংলার রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা পাওয়ার দাবি ছিল সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত।
একুশে মূলত বাংলাদেশের জনগণকে একটি সংগ্রামী চেতনা উপহার দিয়েছে। সেই সূত্র ধরে পরে স্বাধীনতার স্পৃহা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। পৃথক ও সার্বভৌম জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের দাবি ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। চূড়ান্তপর্যায়ে স্বাধীনতার দাবি জোরদার হয়। দেখা গেল, শোষণ ও বঞ্চনা করছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই বঞ্চনার চূড়ান্ত ছিল ১৯৭০ সালে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করা। এর পরিণামে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়, যা ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করেছিল।
কোটি কোটি প্রাণের উচ্ছ্বাস ও আবেগের বন্যায় বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছে। তবে সেই ভাষা আজ নানা দূষণের শিকার। ‘আকাশ সংস্কৃতি’র বদৌলতে এখন আমাদের ঘরে ঘরে শিশুরা বাংলার বদলে হিন্দিতে কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। সমাজের অনেক ক্ষেত্রে চলছে হিন্দির সর্বগ্রাসী আগ্রাসন। এর সাথে রয়েছে ইংরেজি। তবে আমরা সর্বপ্রথমে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করব। তারপর প্রয়োজনীয় বিদেশী ভাষার চর্চা করতে হবে। কিন্তু এখন বাংলাকে জলাঞ্জলি দিয়ে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের দরজা অনেকেই খুলে দিচ্ছি। বহু উচ্চবিত্ত পরিবারে বাংলার পরিবর্তে সে দুটো ভাষারই দাপট। মধ্যবিত্ত ও সাধারণ পরিবারেও অনেক ক্ষেত্রে বাংলা আজ অবহেলিত।
মহান একুশে এখন আনুষ্ঠানিক সর্বস্ব, মিনার ও মেলাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। আমরা যেন শুধু বাগাড়ম্বর করে বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা দেখাতে চাই। কিন্তু মাতৃভাষাকে আমরা জীবনের সাথে মিলিয়ে নিতে চাই না। এমন কৃত্রিমতা মাতৃভাষার বিকাশে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করবে। এ ধরনের মানসিকতা থেকে সরে আসার শপথ নেয়ার দিন আজ। ভাষার মর্যাদার জন্য যারা রক্ত দিয়েছেন, তাদের ঋণ পরিশোধ করতে সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের চেষ্টা চালাতে হবে সর্বান্তকরণে।


আরো সংবাদ



premium cement