২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
কবি আল মাহমুদের ইন্তেকাল

জাতির এই শূন্যতা অপূরণীয়

-

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যপ্রতিভা এবং আমাদের কবিতার জগতে নতুন ও অনুপম এক ভিন্ন ধারার প্রতিভূ কবি আল মাহমুদ আর নেই। শুক্রবার রাতে তিনি রাজধানীর একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। এর আগে কয়েক দিন ধরে তিনি গুরুতর অসুস্থাবস্থায় ছিলেন চিকিৎসাধীন। আল মাহমুদ কয়েক বছর ধরে বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগছিলেন। তার মতো অনন্য সৃজনশীল ও আদর্শবাদী সাহিত্য প্রতিভার ইন্তেকালে পুরো বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে যে শূন্যতার সৃষ্টি হলো তা অপূরণীয়।
দেশবাসীর সাথে একাত্ম হয়ে আমরা জাতির এই বরেণ্য ব্যক্তিত্বের রূহের মাগফিরাত কামনা করি পরম করুণাময়ের কাছে। মরহুমের শোকাহত পরিবারপরিজনের প্রতি রইল আমাদের গভীর সহানুভূতি। যদিও তিনি পরিণত বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেছেন, তার চিরবিদায়ে আমাদের শোক ও মর্মবেদনা প্রকাশের ভাষা নেই। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কবি আল মাহমুদের নেক আমলগুলো কবুল করে তাকে জান্নাতে স্থান দিনÑ আজকের এই বেদনাবিধুর মুহূর্তে এটাই আমাদের আকুতি ও প্রার্থনা।
আল মাহমুদ কাব্যচর্চা, তথা সাহিত্য সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন সুদীর্ঘ ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে। তার চেয়েও বড় কথা, তিনি বাংলা সাহিত্যে এ দেশের লোকজীবন ও ঐতিহ্যের সাথে আমাদের বিশ্বাস ও মূল্যবোধসম্পৃক্ত, সম্পূর্ণ নতুন এক গতিশীল ও জীবনমুখী ধারার প্রবর্তক ও প্রতিষ্ঠাতা। প্রায় চার দশক আগেই তিনি দৃঢ়বিশ্বাসে ঘোষণা করেছিলেন, ‘কলকাতা নয়, ঢাকাই হবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের রাজধানী বা প্রাণকেন্দ্র।’ তখন অনেকেই এ কথা শুনে চমকে উঠলেও এখন এটাই অনস্বীকার্য যে, আল মাহমুদের দূরদর্শিতাপূর্ণ সে ভবিষ্যদ্বাণীই বর্তমান বাস্তবতা। আজ কলকাতার শীর্ষস্থানীয় কবি ও লেখকেরাও এটা স্বীকার না করে পারছেন না। শুধু তা-ই নয়; আল মাহমুদ আমাদের জাতিসত্তার রূপকার এবং জাতীয় সংগ্রামী চেতনার বাতিঘর।
শুধু কবিতাতেই নয়, সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার ছিল অবাধ বিচরণ। তার লেখা গল্পগুলো বাংলা ছোটগল্পের ধারায় অত্যন্ত সফল সংযোজন। পানকৌড়ির রক্ত বা সৌরভের কাছে পরাজিত যেকোনো ছোটগল্পকারের কাছেই ঈর্ষণীয় সাফেল্যের স্মারক। উপন্যাসেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ‘উপমহাদেশ’ ও ‘কাবিলের বোন’ নামের দুটি উপন্যাস আমাদের সমসাময়িক ইতিহাসের অনবদ্য ও বস্তুনিষ্ঠ উপাদানে সমৃদ্ধ। আগুনের মেয়েসহ অন্যান্য যে কয়েকটি উপন্যাস তিনি লিখেছেন তার কোনোটিই শিল্পমূল্যে নগণ্য নয়। আর যেভাবে বেড়ে উঠির মতো আত্মজৈবনিক রচনা তো বাংলা সাহিত্যে এ ধরনের যেকোনো রচনার অনন্য উদাহরণ। আল মাহমুদের যারা একনিষ্ঠ পাঠক তাদের কাছে ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ এক অনিবার্য ও অপরিহার্য পাঠ্য।
আল মাহমুদকে নিয়ে নানা ধরনের বিতর্ক নানা সময়ে উঠেছে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে কে বড় কবি সেই নিয়েও বিতর্কে আল মাহমুদ অন্যতম আলোচিত ব্যক্তিত্ব। রাজনৈতিক অবস্থানগত বিতর্ক বহুকাল ধরে তার পিছু ছাড়েনি। কিন্তু তিনি আলোচনায় ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। কারণ বাংলা কবিতায় জীবনানন্দের পর শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে তার অবস্থান সুচিহ্নিত না হওয়া পর্যন্ত এই বিতর্ক চলতে থাকবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
রাজনৈতিক কারণে একজন কবিকে অসম্মান করা অথবা প্রাপ্য সম্মানটুকু না দেয়া কোনোওভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু বাস্তবে তাই ঘটতে চলেছে। মৃত্যুর দুয়ার পেরিয়ে গিয়েও আল মাহমুদ যোগ্য মর্যাদা পাচ্ছেন না রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বা সমাজের পক্ষ থেকে। এটি আল মাহমুদকে নয় বরং জাতি হিসেবে আমাদের নিজেদেরকেই খাটো করবে। এটি আমাদের হীনম্মন্যতাকে স্পষ্ট করে দেবে। কবিতায় আল মাহমুদ বলেছিলেন, আমার যাওয়ার কালে খোলা থাক জানালা দুয়ার/ যদি হয় ভোরবেলা স্বপ্নাচ্ছন্ন মুভ শুক্রবার।
ঠিক সেই শুক্রবারেই তার জীবনের মায়াবি পর্দা দুলে উঠল। তিনি বিদায় নিলেন ভোরবেলা নয় শান্ত ¯িœগ্ধ মধ্যরাতের আগে চিরস্থায়ী অপর জীবনের পথে। এ যাত্রা মহিমময়, গৌরবের, পরম করুণাময়ের প্রত্যক্ষ অনুগ্রহের স্পর্শ তার মাথায়।
কবি আল মাহমুদের প্রদর্শিত পথে চলে, তার অনুসৃত আদর্শ বাস্তবায়ন এবং আরাধ্য কাজ সম্পন্ন করা হলেই তার প্রতি সত্যিকার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন সম্ভব। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতের শ্রেষ্ঠতম স্থান বরাদ্দ করুন, সেই মুনাজাত আজ।

 


আরো সংবাদ



premium cement