২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`
দুই বছরে ৬৪ জন পাথর শ্রমিকের মৃত্যু

জাফলং আজ মারণফাঁদ

-

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন কেন্দ্র, সিলেটের জাফলংয়ে অবৈধভাবে এবং অনিরাপদ পন্থায় পাথর তোলার কাজে নিয়োজিত আরো একজন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে মাত্র দুই বছরে পাথর কোয়ারিগুলোতে নিহত শ্রমজীবীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৪। গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত দু’জনের মৃত্যু ঘটেছে সেখানে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, সৌন্দর্যের লীলাভূমি জাফলং যেন মারণফাঁদে রূপ নিয়েছে।
পত্রিকার খবরে প্রকাশ, ১০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় জাফলং জিরোপয়েন্ট সংলগ্ন স্থানে, পাথর উত্তোলনের একটি অবৈধ গর্তে শ্রমিকেরা পাথর সংগ্রহ করছিলেন। এ সময় হঠাৎ গর্তের পাড় ধসে পড়ে এবং এতে ৫০ বছর বয়সী এক শ্রমিক মারাত্মকভাবে আহত হন। লোকজন এ খবর পাওয়ার আগেই তাকে দ্রুত সিলেট শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে গেছে এক দিন পর। পাথরের গর্তটির মালিককে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। তাকে প্রধান আসামি করে মামলা করেছেন নিহত শ্রমিকের স্ত্রী।
জানা গেছে, নিসর্গ ভূমি জাফলংয়ের কোয়ারি মালিকেরা আইনের কোনো তোয়াক্কা না করে প্রশাসনের নাকের ডগাতেই যন্ত্রদানবের যথেচ্ছ অপব্যবহারের মাধ্যমে এবং অপরিকল্পিত পদ্ধতিতে দিনরাত ভূগর্ভের পাথর উত্তোলন করছে। এ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে দারিদ্র্যক্লিষ্ট কিছু অভাবী অসহায় মানুষকে। তাদের বেশির ভাগের বাড়ি অন্যান্য জেলায়। পে-লোডার, এক্সকেভেটর, বোমা মেশিন প্রভৃতির সাহায্যে নির্বিচারে পাথর তুলতে গিয়ে জাফলংয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও নৈসর্গিক পরিবেশ বিনষ্ট করা হচ্ছে। সর্বোপরি, বিপন্ন হচ্ছে সংশ্লিষ্ট মেহনতি মানুষদের জীবন। সম্প্রতি নিকটবর্তী ভারতীয় রাজ্য মেঘালয়ে কোয়ারির মাটি ধসে বেশ কয়েকজন শ্রমিকের অপমৃত্যু ঘটেছে। স্মর্তব্য, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সিলেট-তামাবিল হাইওয়ের দুই পাশের পাথর চূর্ণ করার বহু ক্রাশার মিল উচ্ছেদ করে সেখানে কয়েক হাজার একর ভূমিতে বৃক্ষ রোপণ করা হয়েছিল। বন বিভাগ গড়ে তুলেছিল ‘গ্রিন পার্ক’ নামের বিশাল প্রকল্প। তবে আজো এ জন্য পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ কিংবা উন্নয়নকাজ করা হয়নি। এ দিকে, সেসব বৃক্ষ নিধন করে গড়ে তোলা হচ্ছে পরিবেশ দূষণকারী কয়লার ডাম্পিং ইয়ার্ড এবং চালু করা হচ্ছে আবার পাথরের ক্রাশার মেশিন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং জাফলং এসে একে ‘পর্যটন নগরী’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে গেছেন। তবে কিছু অসৎ কর্মকর্তা ও মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর কারসাজিতে তার সে ঘোষণা বাস্তবায়নের কাজ আর দেখা যায়নি। অথচ এলাকার নদী, পাহাড়-টিলা, জুম বাগান প্রভৃতি দখল করে পাথর তোলা হচ্ছে ভূগর্ভ থেকে। এতে প্রাকৃতিক পরিবেশের বড় বিপর্যয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ২০১৮ সালে ছয়জন কোয়ারি শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যুর ধারাবাহিকতায় এ পর্যন্ত ৬৪ জনকে প্রাণ দিতে হয়েছে ‘পরিবেশখেকো’ পাথর ব্যবসায়ীদের অপরিণামদর্শিতায়। পর্যটকদের নিরাপত্তার স্বার্থে পাথর তোলা নিষিদ্ধ হলেও কিভাবে তা দিনরাত চলতে পারে? জানা যায়, পাথর কোয়ারি ব্যবসায়ীরা আদালতের নির্দেশনা নিয়ে পাথর উত্তোলন আবার শুরু করে দেয়। অথচ নির্দেশ ছিল, কেবল ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে এই পাথর সংগ্রহ করা যাবে। এটাকে অমান্য করে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পাথর তোলা হচ্ছে, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
আমরা আশা করি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পর্যটক আকর্ষণ, শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা, পরিবেশ রক্ষাÑ এসব কিছুকে গুরুত্ব দিয়ে অবিলম্বে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বেআইনিভাবে পাথর তোলার বিরুদ্ধে। এতে জড়িত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করাই সময়ের দাবি।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement