১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
হারিয়ে যাচ্ছে নদ-নদী

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি

-

এককালের নদীমাতৃক বাংলাদেশকে এখন আর এই অভিধায় চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। অসংখ্য নদী মরে গেছে, অনেকগুলো মুমূর্ষু। পদ্মা, ব্রহ্মপুত্রের মতো বড় বড় নদীও অস্তিত্ব হারানোর শঙ্কায় ধুঁকছে। ছোট নদীগুলো এখন পানির অভাবে যেন মরা খাল।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে, নদী গবেষকেরা বলছেন, ষাটের দশকে সাড়ে ৭০০ নদী ছিল বাংলাদেশে। এ সংখ্যা কমে মাত্র ২৩০টিতে দাঁড়িয়েছে। ৫০ বছরে হারিয়ে গেছে ৫২০টি নদী। অবশ্য সরকারি হিসাবে দেশে এখন নদীর সংখ্যা ৪০৫। বাস্তবতা হলো, শুকনো মওসুমে এসব নদীতে পর্যাপ্ত পানি থাকে না।
নদীর ‘মৃত্যু’র নানা কারণ রয়েছে এবং সেগুলো সরকার, প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট গবেষক এবং সাধারণ মানুষও জানেন। নদীর অস্তিত্বের জন্য প্রধান হুমকি হলো দখল ও দূষণ। খোদ রাজধানীর চারপাশের নদীগুলোও মরে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত দখল ও দূষণের কারণে। ঢাকার চারপাশের শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বুড়িগঙ্গার সর্বত্রই চলছে দখলবাজদের আগ্রাসী থাবা। শুধু নদীর দুই পাড় দখল করেই ক্ষান্ত হয়নি দখলবাজরা, তারা প্রবহমান নদীর পানিতেও বাঁশ-কাঠের মাচান তুলে বানিয়েছে ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও বালুমহাল। বিষাক্ত তরল বর্জ্যে বিপন্ন হয়েছে পরিবেশ; নাগরিক জীবনেও নেমে এসেছে নানা বিপর্যয়।
রাজধানীতেই যখন এমন অবস্থা, তখন সারা দেশের নদ-নদীর অবস্থা কেমন তা সহজেই বোঝা যায়।
নদীর সাথে পরিবেশের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নদী যেমন তার প্রবাহের সাথে জনপদের বর্জ্য সরিয়ে নিয়ে যায়, তেমনি নদীর পানির কারণে আশপাশের পরিবেশ থাকে অপেক্ষাকৃত শীতল। নদী থেকেই উৎসারিত হয় জলীয়বাষ্প এবং তা আবার বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। নদী না থাকলে এ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াটি ব্যাহত হবে, যার আলামত এরই মধ্যে অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমছে এবং খরাপ্রবণতা বাড়ছে। উষ্ণ হয়ে উঠছে আবহাওয়া। নদীর সাথে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের যে সম্পর্ক নিবিড়ভাবে জুড়ে আছে যেমনÑ ফসল ফলানো, যাতায়াত, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির প্রসঙ্গ বাদ দিলেও পরিবেশের বিষয়টি কোনোভাবেই উপেক্ষা করার মতো নয়। নদী না থাকা এবং নদীদূষণের সাথে মানুষের স্বাস্থ্যগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও রয়েছে।
বিস্ময়কর হলেও সত্য, নদ-নদীর দখল রোধে উচ্চ আদালতের দেয়া দুই দফা নির্দেশনার প্রতি অনেকটা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। জবরদখল থামাতে মাঝে মধ্যে সরকারি পদক্ষেপ নেয়া হলেও নানা ফাঁক-ফোকর আর সীমাবদ্ধতায় মাঝপথেই তা থমকে যায়। ফলে প্রভাবশালী নদী দখলবাজরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ঢাকার চারপাশের নদ-নদীর দখলবাজি রোধে হাইকোর্ট ২০০৯ সালের ২৫ জুন ১২ দফা নির্দেশসহ রায় জারি করেছেন। রায়ে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, তুরাগÑ এ চারটি নদীর সীমানা সিএস রেকর্ড অনুযায়ী নির্ধারণের আদেশ দেয়া হয়। এ ছাড়া, তীরবর্তী অবৈধ স্থায়ী ও অস্থায়ী স্থাপনা উচ্ছেদসহ ১২ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন আদালত। কিন্তু বাস্তবে উচ্চ আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়নের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কারো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।
ইমেরিটাস অধ্যাপক ও পানিবিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাতের বক্তব্য উদ্ধৃত করে পত্রিকার খবরে জানানো হয়, তিনি বলেনÑ ‘দেশ বাঁচাতে হলে নদী বাঁচাতে হবে। এ ব্যাপারে হাইকোর্ট যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের। ভূমি মন্ত্রণালয়, প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা আন্তরিক না হলে নদীরক্ষা করা সম্ভব হবে না।’
সত্যিকার অর্থে নদীর অস্তিত্ব বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের অতি আলোচিত বিষয়ের সাথে জড়িত। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের এক বড় শিকার। বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের বিরাট এলাকা সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলার সক্ষমতা এককভাবে আমাদের নেই। কিন্তু দেশের নদ-নদী রক্ষার মাধ্যমে আমরা সম্ভবত পরিস্থিতির অবনতির মাত্রা কমিয়ে আনতে পারি। আন্তর্জাতিক নদীর ওপর একের পর এক বাঁধ দিয়ে এগুলোর পানিপ্রবাহে প্রতিবেশী বৃহৎ দেশের বাধা সৃষ্টি করা আমাদের জন্য মৃত্যুর চেয়েও কঠিন। এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ কখনোই নেয়া হয়নি। নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ও আমাদের পরিবেশ রক্ষার অন্যতম প্রধান অ্যাজেন্ডা হওয়া উচিত। সরকারকে অবিলম্বে বিষয়টি ভেবে দেখার অনুরোধ জানাই।


আরো সংবাদ



premium cement