২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`
সড়ক উন্নয়নে ব্যয়ের ‘বিশ্ব রেকর্ড’!

দুর্নীতি-অনিয়ম রোধ করা জরুরি

-

বাংলাদেশ দুর্নীতির ক্ষেত্রে ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন’ হিসেবে অভিহিত হয়েছিল কয়েক বছর ধরে। এখন বলা হচ্ছে, দেশটি সড়কের পেছনে ব্যয়ের পরিমাণের দিক দিয়ে একধরনের ‘বিশ্ব রেকর্ড’ গড়েছে। মঙ্গলবার নয়া দিগন্তের লিড রিপোর্টে জানানো হয়েছে, চীন ও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে চার লেন সড়ক তৈরি করার খরচ অনেক বেশি। এখানে মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার ব্যয়ের বহরও বেশি। যেমন ফেনী-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়ক দুই লেন থেকে চার লেন করতে খরচ হচ্ছে কিলোমিটার-প্রতি ২৭ কোটি ৪৬ লাখ ৩২ হাজার টাকা, অথচ বিশ্বব্যাংকের হিসাব মোতাবেক, প্রতিবেশী দেশ ভারতে এই ব্যয় মাত্র ১০ কোটি টাকা এবং চীনে ১৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ একই কাজে বাংলাদেশে খরচ করতে হয় চীনের দ্বিগুণেরও বেশি। বিশ্বব্যাংক জরিপের ভিত্তিতে অভিমত দিয়েছে, দুর্নীতি, প্রকল্প যথাসময়ে সম্পন্ন না হওয়া, প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি করা প্রভৃতি কারণে সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণে ব্যয় অধিক হচ্ছে।
এ দিকে, সংশ্লিষ্ট প্রকল্পপ্রস্তাব থেকে জানা যায়, ফেনী থেকে নোয়াখালী পর্যন্ত ৩০ দশমিক ১৯ কিলোমিটার মহাসড়কের দুই লেনের অংশ প্রশস্ত করে চার লেনে উন্নীতকরণের ব্যয় ৮২৯ কোটি ১১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। অর্থাৎ, প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে ২৭ কোটি ৪৬ লাখ ৩২ হাজার টাকা। এর পরিমাণ ‘যৌক্তিক পর্যায়ে’ নামিয়ে আনতে বলেছে পরিকল্পনা কমিশন। একই প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ব্যয়ের মাত্রাও অতিরিক্ত। দেখা গেছে, ১৫ দশমিক ৭৫ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করতে ব্যয় নির্ধারিত হয়েছে ২০৩ কোটি ৭৬ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। ফলে প্রতি হেক্টর জমির জন্য ব্যয় করতে হবে ১২ কোটি ৯৩ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। এ অবস্থায় পরিকল্পনা কমিশন বলেছে বাজারদর অনুযায়ী জমির দাম নির্ধারণ করার জন্য। কমিশনের মূল্যায়ন কমিটির সভায় এই প্রকল্পের ব্যয়ের সব খাতেই ব্যয়ের পরিমাণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জানা যায়, ঢাকা-সিলেট চার লেন মহাসড়ক প্রকল্পে এক একর জমির দাম চার কোটি ৪৩ লাখ টাকা। কিন্তু নোয়াখালীর আলোচ্য প্রকল্পে দর ধরা হয়েছে এর চেয়ে ৮১ লাখ টাকা বেশি।
স্মর্তব্য, বিশ্বব্যাংক গত বছর বাংলাদেশের বাজেট প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিল, এ দেশে প্রকল্প প্রণয়নকালে এ জন্য যে ব্যয় ধরা হয়, পরে সে ব্যয় বেড়ে যায়। এভাবে শুরু হয় দুর্নীতি। এতে নির্মাণব্যয় বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থায় সড়ক নির্মাণ খাতে বাংলাদেশে ব্যয়ের হার চীন ও ভারতের চেয়ে অনেক বেশি।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকার মুখ্য অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, ‘বাংলাদেশে প্রকল্পের কাজে জমি অধিগ্রহণ একটা বড় সমস্যা। এই অধিগ্রহণ এবং এর মূল্য শোধের ক্ষেত্রে দুর্নীতি করা হয়। ভূমির মালিক পান কম দাম; অথচ সরকারকে দেখানো হয় যে, অনেক দাম দেয়া হয়েছে।’ তার মতে, ‘টেন্ডারে প্রতিযোগিতা না থাকায় সড়ক ও মহাসড়ক নির্মাণের খাতে মালামাল কেনার বেলায়ও দুর্নীতি হয়ে থাকে। তদুপরি, বাংলাদেশে কোনো প্রকল্প যথাসময়ে শেষ হয় না। এ দিকে, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে ব্যয়ের পরিমাণ।’
কারণ থাক বা না থাক, প্রকল্পের ব্যয় দফায় দফায় বিপুল বাড়িয়ে দেয়ার নজির এ দেশে অনেক। সাম্প্রতিককালে ঢাকার ফাইওভার এবং পদ্মা সেতুর কাজেও এটি পরিলক্ষিত হয়েছে। সাধারণত ব্যয় বৃদ্ধির সাথে সাথে আত্মসাৎ বা দুর্নীতির পরিমাণও বেড়ে যায়। কথায় বলে, ‘প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ যত বেশি; কর্তাদের কমিশনও তত বেশি।’ অতএব, একশ্রেণীর আমলা আর সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারেরা মিলে একটি অসৎ চক্র ‘সরকার কা মাল, দরিয়ামে ঢাল’ বাস্তবায়নে তৎপর থাকেন। এতে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের বিরাট অঙ্কের অর্থের শুধু অপচয় নয়, জনগণের এই অর্থ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়। পকেট ভারী হয় দুর্নীতিবাজ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের।
আমরা চাই, বাংলাদেশ আর যেন নেতিবাচক রেকর্ড গড়ার জন্য সংবাদ শিরোনাম না হয়। দেশের সত্যিকার ও টেকসই উন্নয়নের জন্য সুশাসন তথা সততা ও জবাবদিহিতা প্রয়োজন। সবার প্রত্যাশা, প্রকল্পের নিয়মিত ও কার্যকর মনিটরিং এবং আইন ও বিধি কঠোর প্রতিপালনের মাধ্যমে সব ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধের পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেয়া হবে।


আরো সংবাদ



premium cement