১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বেপরোয়া যুক্তরাষ্ট্র, চ্যালেঞ্জে তুরস্ক

এরদোগান-ট্রাম্প বৈঠক -

এবার তুরস্কের সাথে বাণিজ্যযুদ্ধে নামলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। দেশটি থেকে পণ্য আমদানির ওপর নতুন করে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের মাধ্যমে এই যুদ্ধের সূচনা করেছে হোয়াইট হাউজ। বসে নেই তুরস্কও, পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ইতোমধ্যেই মার্কিন ইলেকট্রনিক পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান। দু-এক দিনের মধ্যে আরো কঠোর কোনো সিদ্ধান্ত এলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই নতুন পদক্ষেপের পর দুটি প্রশ্ন জোরালো হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেÑ এক. তুরস্ক কি পারবে যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিয়ে টিকে থাকতে? দুই. ট্রাম্প যে একটির পর একটি দেশের সাথে শত্রুতা বাড়াচ্ছেন, এর পরিণতি কী?
গত সপ্তাহে হঠাৎ করেই তুরস্ক থেকে স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম পণ্য আমদানির ওপর ২০ থেকে ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের এই ঘোষণায় হতচকিত হয়ে পড়ে বিশ্ব, কারণ দীর্ঘ প্রায় ছয় দশক ধরেই তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্র পরস্পরের মিত্র হিসেবে পরিচিতি। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর প্রথম সারির সদস্যরাষ্ট্র তুরস্ক। ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক বাহিনী রয়েছে তুরস্কের। এর বাইরেও দুই দেশের সম্পর্কের রয়েছে নানা সমীকরণ। যদিও সম্প্রতি ওয়াশিংটন ও আঙ্কারার মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন চলছিল।

বৈরিতার শুরু যেভাবে
সাদা চোখে ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই তুরস্কে সেনাবাহিনীর একটি অংশের অভ্যুত্থান চেষ্টাকেই পশ্চিমাদের সাথে তুরস্কের সম্পর্কের অবনতির সূত্র হিসেবে ধরা হয়। প্রথমত, ওই অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রসহ তাদের ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলো যথাযথ অবস্থান নেয়নি। তুরস্ক চেয়েছিল দেশটির গণতন্ত্রের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেবে তাদের মিত্ররা; কিন্তু তা দেখা যায়নি। এ ছাড়া অভ্যুত্থান চেষ্টার মূল পরিকল্পনাকারী ফতেহউল্লেহ গুলেন আছেন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ে, তুরস্ক বারবারই অনুরোধ করছে তাকে তুরস্কের কাছে হস্তান্তর করতে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টিতে কর্ণপাত করছে না। এ ছাড়া এই অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার অভিযোগে একজন মার্কিন ধর্মযাজককে গ্রেফতার করে তুর্কি পুলিশ। তার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানে জড়িত থাকা ও তুরস্কের বিচ্ছিন্নতাবাদী কুর্দি গ্রুপগুলোর হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আছে।
যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছুদিন ধরে তুরস্ককে চাপ দিচ্ছে ওই ধর্মযাজককে ফেরত পাঠানোর, কিন্তু এতে বেঁকে বসেছে এরদোগান সরকার। তুর্কি আদালতে বিচার চলছে ওই যাজকের বিরুদ্ধে। আর এ ঘটনাকে ইস্যু করেই ট্রাম্প প্রশাসন নেমেছে তুরস্কের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক কঠোরতা আরোপ করতে। ফলে প্রকাশ্য বৈরিতার সূচনা হয় দুই দেশের।
যদিও এসব ঘটনার বীজ বোনা হয়েছে আরো অনেক বছর আগে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের সম্পর্কের অবনতির একটা কারণ তুরস্কের উদার পররাষ্ট্রনীতি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্ক এমন কিছু দেশের সাথে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করেছে, যা ওয়াশিংটনের জন্য অস্বস্তিকর। যার মধ্যে প্রধান রাশিয়া। গত কয়েক বছর ধরেই রাশিয়ার সাথে তুরস্কের সম্পর্ক অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক ভালো। সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ইস্যুতে দুই দেশ অনেকবার আলোচনায় বসেছে, আবার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বেড়েছে আন্তরিকতা। সিরিয়া ইস্যুতে বিরোধিতা থাকলেও বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ইস্যুতে দুই দেশকে এক মেরুতে দেখা যাচ্ছে; কিন্তু বিষয়টি পছন্দ নয় যুক্তরাষ্ট্রের।
ন্যাটোর জোটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে জোটের প্রধান শত্রু হিসেবে পরিচিত রাশিয়ার সাথে দহরম-মহরম পছন্দ করছে না ন্যাটোও। আবার যুক্তরাষ্ট্রের আরেক শত্রুরাষ্ট্র ইরানের সাথেও সম্প্রতি সম্পর্ক বৃদ্ধি করছে আঙ্কারা। সেটিও অপছন্দের হোয়াইট হাউজের। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরুদ্ধেও একাধিকবার সোচ্চার হয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট, সংস্থাটি বছরের পর বছর তুরস্কের সদস্যপদ লাভের বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখেছে। এরদোগান হয়তো বুঝতে পেরেছেন, তার দেশকে কখনোই নিজেদের জোটে নেবে না ইউরোপীয়রা। তাই আর ইউরোপের অনুগত না থেকে কথা বলতে শুরু করেছেন বিভিন্ন স্পর্শকাতর ইস্যুতে। তুরস্কের অভ্যন্তরীণ বিষয়েও নাক গলাতে না করেছে ইউরোপকে। সংবিধান পরিবর্তনবিষয়ক গণভোটের সময় তো জার্মানি, নেদারল্যান্ডসহ অনেক দেশ প্রকাশ্যে চেষ্টা করেছে গণভোটকে বাধাগ্রস্ত করতে।
কাজেই ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সাথে তুরস্কের সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

ট্রাম্প কেন বেপরোয়া
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার অঙ্গীকার করে নির্বাচনে জিতেছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ওয়াদা করেছিলেন, দেশের অর্থনীতির ওপর থেকে বিদেশীদের প্রভাব কমিয়ে আনবেন। কিন্তু সেই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তিনি একের পর এক দেশের সাথে শত্রুতা তৈরি করছেন।
কয়েক মাস আগে চীনের সাথে পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ব। অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীন ছেড়ে কথা বলেনি যুক্তরাষ্ট্রকে। ফলে দুই দেশের দীর্ঘ দিনের কূটনৈতিক বৈরিতা এসে পড়েছে বাণিজ্য খাতেও। চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য এখন অনেকটাই স্থবির।
এবার তুরস্কের সাথে একই পথে হাঁটতে চলেছে ওয়াশিংটন। রাশিয়ার সাথে বৈরিতা তো সেই কবে থেকেই, ট্রাম্প প্রশাসন আসার পর রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের কিছুটা সম্ভাবনা তৈরি হলেও কয়েক দফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক খারাপ গত বছরখানেক ধরে। মধ্যপ্রাচ্যে ইরান তো ‘শত্রু’ রাষ্ট্র হিসেবেই পরিচিত। এর আগে ট্রান্স-আটলান্টিক বাণিজ্যচুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে, যাতে ক্ষুব্ধ হয়েছে কানাডার মতো তাদের মিত্র রাষ্ট্রগুলোই। কাজেই বিশ্বে একের পর এক বৈরী রাষ্ট্রের সংখ্যা বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের।
তার ওপর কিছুদিন আগেও ইউরোপীয় মিত্রদের সম্পর্কে বাণিজ্য ও সামরিক ইস্যুতে কঠোর মন্তব্য করেছেন ট্রাম্প। ন্যাটো সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে চাপ দিচ্ছে সামরিক বাজেট বৃদ্ধির জন্য। এসব পরিস্থিতির কোনো সন্তোষজনক কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। উদার বাণিজ্যনীতির যুগে সবাই যখন নতুন নতুন ব্যবসায় ক্ষেত্র ও বাজার তৈরিতে ব্যস্ত, তখন যুক্তরাষ্ট্র হাঁটছে উল্টো পথে।


চ্যালেঞ্জে তুরস্ক

যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশ থেকে স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানি করে, তুরস্কের নাম সেই তালিকার উপরের দিকে। ২০১৭ সালে দেশটি থেকে ১০০ কোটি ডলারের বেশি স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে এমন একটি বাজার নষ্ট হলে তুরস্কের অর্থনীতির জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দেবে বিষয়টি। গত কিছুদিন ধরেই খারাপ সময় পার করছে তুরস্কের অর্থনীতি।
মার্কিন ডলারের বিপরীতে তুর্কি মুদ্রা লিরার মান অনেক দিন ধরেই পড়তির দিকে, শুল্ক আরোপের ঘটনায় সেটি আরো কমেছে।
মাঝারি অর্থনীতির একটি দেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের সাথে শত্রুতা নিয়ে চলা সত্যিই কঠিন।
অবশ্য দুই-তিন বছর ধরেই অর্থনৈতিক খাতে বিকল্প মিত্র খুঁজে পেতে কাজ করছে তুরস্ক। পশ্চিমা নির্ভরতা কমিয়ে, বিশ্বের সব অঞ্চলের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইছে তারা। রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি তো বাণিজ্যিকসহ সব ক্ষেত্রেই বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে কাতারের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক কয়েকগুণ বেড়েছে, বেড়েছে চীনের সাথেও। গত মাসে এরদোগান আফ্রিকা সফর করে ওই অঞ্চলে বাণিজ্য প্রসারের অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছেন।
এরদোগানের হাত ধরেই তুরস্কের অর্থনীতি স্বাবলম্বী হয়েছে। তাই এবারের চ্যালেঞ্জ দেশটি কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে মনে করছেন খোদ মার্কিন বিশেষজ্ঞরাই। অনেকেই বলছেন, ট্রাম্পের এই ক্ষ্যাপাটে সিদ্ধান্তে আখেরে লাভটা হবে তুরস্কেরই। নতুন বাজার, নতুন মিত্র খুঁজে নেবে তারা। আর আরব রাষ্ট্রগুলোর অবরোধের মুখে মধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট দেশ কাতারের টিকে থাকার উদারহরণ তো সামনেই রয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশী : পররাষ্ট্রমন্ত্রী চন্দনাইশ, বাঁশখালী ও বোয়ালখালীতে ৩ জনের মৃত্যু গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়াল শ্যালকের অপকর্মে দুঃখ প্রকাশ করলেন প্রতিমন্ত্রী পলক রাজশাহীতে ট্রাকচাপায় ৩ মোটরসাইকেল আরোহী নিহত পাবনায় দুই গ্রুপের সংঘর্ষে হতাহত ২২ বিল দখলের চেষ্টা, জেলা ছাত্রলীগ নেতাকে গণপিটুনি ‘শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জীবিত হয়ে কাজ করলে বিজয় অনিবার্য’ কারাগারে নারী হাজতিকে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন, প্রধান কারারক্ষীসহ ৩ জনের বদলি প্যারিসে ইরানি কনস্যুলেটে ঢুকে আত্মঘাতী হামলার হুমকিদাতা গ্রেফতার প্রেম যমুনার ঘাটে বেড়াতে যেয়ে গণধর্ষণের শিকার, গ্রেফতার ৫

সকল