২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মার্কিন অবরোধ মোকাবেলায় ইরান

আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি -

মার্কিন একতরফা অবরোধের খড়গে পড়ল ইরান। আমেরিকার একরোখা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ৭ আগস্ট রাতে ইরানের ওপর অবরোধ পুনর্বহালের নির্বাহী আদেশে সই করেন। ফলে গুরুত্বপূর্ণ খাতে ইরানের ওপর একগুচ্ছ নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলো। বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেনের ওপর নির্দিষ্টভাবে অবরোধ চাপিয়ে দিলো আমেরিকা। এর মধ্যে মার্কিন ডলার বেচাকেনা ও সংগ্রহ, স্বর্ণ বা অন্যান্য মূল্যবান ধাতু বেচাকেনা, অ্যালুমিনিয়াম, স্টিল ও শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত সফটওয়্যার আমদানি, ইরানের সার্বভৌম ঋণ, জাহাজ নির্মাণ, জ্বালানি খাতসংক্রান্ত লেনদেন এবং ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে বিদেশী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের বিষয়গুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এই অবরোধের ফলে ২০১৫ সালের নভেম্বরে ভিয়েনায় স্বাক্ষরিত ছয় জাতি পারমাণবিক চুক্তির প্রতিশ্রুতি থেকে আমেরিকা পুরোপুরি সরে এলো। গত মে মাসে চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার পর এখন ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিলো আমেরিকা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিশ^শক্তিগুলোর মধ্যে সম্পাদিত ‘জয়েন্ট কমপ্রেহেনসিভ প্লান অব অ্যাকশন’ বা জেসিপিএ-কে একটি ভয়ঙ্কর ও একপেশে উদ্যোগ বলে আখ্যায়িত করে তার থেকে সরে এলেন। মার্কিন অবরোধের মূল লক্ষ্য হলো ইরানের অর্থনীতির প্রাণ তেল শিল্পকে পঙ্গু করা এবং এর মাধ্যমে দেশটির অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড গুঁড়িয়ে দেয়া। বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্র এবং জাতিসঙ্ঘকে উপেক্ষা করে একতরফা অবরোধ আরোপের পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হঙ্কার ছেড়ে বলেন, ‘আমরা আশা করব সব রাষ্ট্র এমন পদক্ষেপ নেবে, যাতে ইরানের সামনে যেকোনো একটি পথ খোলা থাকে, হয় তারা বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতা তৈরির কার্যক্রম বন্ধ করে বিশ্বের অর্থনীতির সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করবে অথবা সারা বিশ্ব থেকে অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।’ ইরানের ওপর আমেরিকার এই নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারীদের প্রতিও ট্রাম্প কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন।

তীব্র প্রতিক্রিয়া চীন, রাশিয়া ও ইইউর
ইরানের ওপর একতরফা মার্কিন অবরোধে বিশ্বশক্তিগুলো তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। বিশেষ করে ইইউ ও ইউরোপের তিন শক্তিধর দেশ জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য মার্কিন সিদ্ধান্তে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা ‘সমঝোতা চুক্তি’ অক্ষুণœ রাখার পক্ষে জোর বক্তব্য পেশ করেছেন। ফলে আমেরিকা তার শক্তিশালী ন্যাটো মিত্রদের সাথে সরাসরি বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে বলে স্পষ্ট লক্ষ করা যাচ্ছে। ইইউর পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান ফেডেরিকা মেঘোরিনি আমেরিকার কঠোর সমালোচনা করে বলেন, ‘ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প শান্তিপূর্ণ রাখার যেই লক্ষ্য ছিল তারা তা যথাযথভাবে পালন করছে। তাই এ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ উদ্যোগের পরিপূর্ণ ও কার্যকর বাস্তবায়নে ইইউ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে।’
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রন এক টুইটার বার্তায় বলেন, ‘মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া অচল হয়ে পড়ল।’ ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস এভস লি ডিরিয়ান বলেছেন, “এই চুক্তি মরে যায়নি। আমরা ইউরোপের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইরানের প্রতিনিধিসহ ‘জেসিপিএ’র ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার জন্য মিলিত হবো।”
জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাস বলেছেন, ‘জার্মানি জেসিপিএ থেকে সরে যাওয়ার কোনো বৈধতা দেখছে না।’ ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন মার্কিন উদ্যোগে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেন, ‘ব্রিটেন জেসিপিএ রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এর অন্য অংশীদারদের সাথে মিলে এই চুক্তি রক্ষায় কাজ করে যাবে।’ ফ্রান্স ও ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, ‘ইরানের সঙ্গে বৈধ বাণিজ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
পারমাণবিক শক্তির অন্যতম দেশ চীন মার্কিন একতরফা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাখ্যান করেছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লু ক্যাং বলেছেন, ‘বেইজিং যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করে এসেছে।’ বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চীন জাতিসঙ্ঘের পক্ষ থেকে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা মেনে চললেও যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা নিষেধাজ্ঞা মানবে না। বিশে^র অন্যতম শক্তিধর দেশ রাশিয়ার পক্ষ থেকেও ইরানের ওপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করা হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস তার প্রতিক্রিয়ায় চুক্তির সব পক্ষকে মিলেমিশে কাজ করার কথা বলেছেন। তার মানে চুক্তি থেকে সরে আসাকে তিনি মানতে চাননি। গুতেরেস বলেন, ‘জেসিপিএ’র কৌশলের মধ্য থেকে সব পক্ষের কাজ করা উচিত।’ অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও তুরস্কসহ বিশ্বের আরো অনেক দেশ ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় হতাশা প্রকাশ করেছে এবং জেসিপিএ মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে।

মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন
ইরানের ওপর একতরফা মার্কিন অবরোধ বৈধ কি না তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। ফলে আমেরিকার নৈতিক ভিত্তি তীব্র ঝাঁকুনি খেয়েছে বলেই মনে হয়। কেননা জেসিপিএতে স্বাক্ষর করে বিশে^র ছয়টি শক্তিধর দেশÑ আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া ও চীন। এই চুক্তি বলে ইরানকে কতগুলো শর্ত মেনে চলতে বাধ্য করা হয়। সমঝোতা চুক্তির শর্ত ইরান মেনে চলছে কি না তা দেখভাল করার দায়িত্ব পালন করে আন্তর্জাতিক আণবিক জ্বালানি সংস্থা। তবে এই সংস্থা বারবার নিশ্চিত করেছে, ইরান যাবতীয় শর্ত পরিপূর্ণভাবে মেনে চলছে। তারপরও মার্কিন অভিযোগ এবং চুক্তি থেকে সরে আসা মোটেও সমর্থনযোগ্য নয়। এমনকি এটা প্রতিশ্রুতির লঙ্ঘন। তা ছাড়া, ছয় জাতির সাথে এই সমঝোতা চুক্তি ‘জেসিপিএ’ জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন লাভ করেছিল। ফলে এটি এখন একটি আন্তর্জাতিক আইন হিসেবে স্বীকৃত। আমেরিকা এই আইনকেও অমান্য করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তারা মার্কিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছেন। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে সম্পাদিত ছয় জাতি চুক্তির (জেসিপিএ) পর ইরানের ওপর থেকে সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। তারপর থেকে ইরানের সাথে ইউরোপের বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক লেনদেন চালু হয়। আমেরিকার এই অবরোধের ফলে এসব প্রতিষ্ঠানও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে বলে ইইউ বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তারা বলছেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে যেসব ইউরোপীয় কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তারা আইনের আশ্রয় পাবে এবং তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে।

মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় ইরানের অবস্থান
ইসলামি ইরান প্রজাতন্ত্র বর্তমানে একটি সুসংগঠিত ও অভ্যন্তরীণভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ দেশ। প্রাকৃতিক তেলসমৃদ্ধ দেশ ইরানের আয়তন ১৬ লাখ ২৯ হাজার ৯১৮ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা আট কোটি ২১ লাখ। এটি পৃথিবীর ১৮তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি তেল ও গ্যাস। রফতানি আয়ের ৬৩.৩ শতাংশ আসে তেল এবং ৫.৯৬ শতাংশ আসে গ্যাস থেকে। তা ছাড়া কেমিক্যাল, প্লাস্টিক ও ফল রফতানি করছে ইরান। ইরানের রফতানির বড় অংশীদার হলো ইউরোপ, তাইওয়ান, তুরস্ক, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারত। দেশটি বর্তমানে প্রতিদিন ৪.১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উত্তোলন করছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, একতরফা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে ইরানের অর্থনীতির ওপর কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে ইরান এর আগেও বহুবার আন্তর্জাতিক ও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। প্রতিবারই সাহসের সাথে সেটি মেকাবেলা করে এগিয়ে গেছে ইরান। তবে মাথা নত করেনি। এবারো ইরান তার দৃঢ় মনোবল প্রকাশ করেছে। সাম্প্রতিক মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে উড়িয়ে দিয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ও দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি।
ইরান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে মিলে পরিস্থিতি মোকাবেলার ঘোষণা দিয়েছে। উল্লেখ্য, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিষেধাজ্ঞা জারির পর ইরানের সাথে আলোচনারও এক প্রস্তাব দিয়েছেন। এর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেছেন, ‘পঙ্গু করে দেয়া নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর কোনো আলোচনা শুরু করা যায় না।’ তিনি আরো বলেন, ‘আপনি কারো শরীরে ছুরি বসিয়ে দিয়ে তাকে আলোচনায় ডাকতে পারেন না। আলোচনায় বসতে হলে আগে ওই ছুরি বের করতে হবে। তারা ইরানের সাথে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই শুরু করেছে। নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর মধ্যস্থতার কোনো মানে হয় না।’

সর্বশেষ পরিস্থিতি
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হলো ইরানের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব। ফলে দেশটিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করেছে। চাকরির বাজার পড়ে গেছে এবং ইরানি মুদ্রার মান কমতে শুরু করেছে। তবে এটি খুবই প্রাথমিক পর্যায়। আশা করা যায়, এই অবস্থার শিগগিরই উত্তরণ ঘটবে। তার কারণ, মার্কিন হুমকি সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন ও রাশিয়া ইরানের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি এক যৌথ বিবৃতিতে ইরানের সাথে বৈধ বাণিজ্য সম্পর্ক রক্ষার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। আশা করা যায়, ইরান সব বাধা উপেক্ষা করে তার দেশের সুরক্ষা ও স্বার্থ অুণœ রেখে এগিয়ে যাবে।


আরো সংবাদ



premium cement
শেখ হাসিনার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি বিএনপিকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে : ওবায়দুল কাদের রাশিয়া সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্টে ১৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে সিরিয়ায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৩৬ সেনা সদস্য দৌলতদিয়া ঘাটে পন্টুন থেকে নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু অ্যানেসথেসিয়ার পুরনো ওষুধ বাতিল করে কেন নতুনের জন্য বিজ্ঞপ্তি! বাইডেনের মেয়াদে রুশ-মার্কিন সম্পর্কের উন্নতির কোনো আশা নেই : রুশ রাষ্ট্রদূত ডিএমপির অভিযানে গ্রেফতার ৪০ নিউইয়র্কে মঙ্গোলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ফ্ল্যাট জব্দ করবে যুক্তরাষ্ট্র! টাঙ্গাইলে লরি-কাভার্ডভ্যান সংঘর্ষে নিহত ১ জিম্বাবুয়ে সিরিজে অনিশ্চিত সৌম্য বেনাপোল সীমান্তে ৭০ লাখ টাকার স্বর্ণের বারসহ পাচারকারী আটক

সকল