২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`
জনতা ব্যাংকে ১০০ ঋণের ৪৮টি ভুয়া!

দায় সরকারকে নিতে হবে

-

রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান জনতা ব্যাংকে দুর্নীতি, অনিয়ম ও লুটপাটের আরো তথ্য বেরিয়ে এসেছে। কৃষিঋণ দানেও অবিশ্বাস্য জালিয়াতি ঘটেছে এ ব্যাংকে। ভূমিহীনকে ভূমিমালিক বানিয়ে নামে-বেনামে ঋণ দেয়া হয়েছে। এ জন্য যেসব দলিল, পর্চা ও সনদ ব্যবহার করা হয়েছে সবই ভুয়া। এমনকি, সংশ্লিষ্ট স্বাক্ষর ও সিলও ছিল নকল। যার নামে ঋণ ‘তৈরি’ করা হয়েছে, তিনি নিজেই জানেন না, তার নামে ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে।
একটি সহযোগী দৈনিক চাঞ্চল্যকর এসব খবর দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দলের প্রতিবেদন সূত্রে। ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে বিপুল অর্থ আত্মসাতের ঘটনাও ধরা পড়েছে জনতা ব্যাংকে। কেন্দ্রীয় পরিদর্শক দল নমুনার ভিত্তিতে রংপুরের আলোচ্য শাখায় ১০০টি ঋণ পরীক্ষা করে ৪৮টিকে ভুয়া হিসেবে প্রমাণ পেয়েছে। ঋণ নিয়ে জালিয়াতি এবং অর্থ আত্মসাতের ঘটনাগুলো ঘটেছে পীরগাছা উপজেলার একটি শাখায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের শেষ দিন পর্যন্ত প্রাপ্ত স্থিতির ওপর ভিত্তি করে বেশ কিছু ঋণ জালিয়াতির উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সহজেই অনুমিত যে, এর পরও ব্যাংকটিতে অনুরূপ ঘটনা ঘটা অব্যাহত রয়েছে। কারণ, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ‘রক্তক্ষরণ’ বন্ধ না হওয়ায় সরকার জনগণের বিপুল অর্থ দিয়ে এ খাতে ‘রক্তসঞ্চালন’-এর জন্য প্রতি বছর প্রয়াস পাচ্ছে। কিন্তু দুর্নীতি-অনিয়ম-প্রতারণা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, জনতা ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও সুপারিশকারীর যোগসাজশে এবং দালাল চক্রের সহায়তায় জালিয়াতি করে বিরাট অঙ্কের অর্থ তসরুফ করা হয়েছে। এমন জালিয়াতির ঘটনা পীরগাছার চৌধুরাণী শাখা ছাড়াও রংপুর অঞ্চলের অন্য কোনো শাখায় ঘটেছে কি না তা খতিয়ে দেখার জন্য প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কৌশল হিসেবে যেসব জালিয়াতি ও অন্যায় করা হয়েছে, তার মধ্যে আছেÑ জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়াই ঋণ দেয়া এবং নিরীহ দরিদ্র মানুষের ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি কৌশলে জোগাড় করে তাদের নাম ভাঙিয়ে আত্মসাতের জন্য ঋণ নেয়া। জনতা ব্যাংকের দুর্বল নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা এবং অদক্ষ অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষাকে এ ধরনের গুরুতর অনিয়মের জন্য দায়ী করা হয়েছে। জনতা ব্যাংকের চাঁদপুর কো-অপারেটিভ, বিআইডব্লিউটিএ ও ফরিদপুর করপোরেট শাখায়ও অনিয়মের খোঁজ পাওয়া গেছে।
স্মর্তব্য, ইতঃপূর্বে রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংকের দুই শাখায় হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি ধরা পড়েছে। ব্যাংকেরই কিছু অসৎ কর্মকর্তার যোগসাজশে ১১টি প্রতিষ্ঠান এই জালিয়াতি করে। এভাবে করপোরেট শাখায় ৬৫৫ কোটি এবং লোকাল অফিস শাখায় ২৬৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। তদুপরি, খেলাপি থাকা সত্ত্বেও এ তালিকা থেকে আবার ঋণ দেয়া হয়েছে। নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কাই করা হয়নি এবং ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের পর্যাপ্ত আমানত পর্যন্ত নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেছেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের বড় রকমের সংস্কার দরকার। অনিয়ম-জালিয়াতি রোধে সরকারকে দ্রুত বিশেষ সংস্কার উদ্যোগ নিতে হবে।’ একটি ব্যাংকের সাবেক এমডি বলেন, ‘ব্যাংকের ভেতরের একটি চক্রই এসব অপকর্ম করে থাকে।’ ওয়াকিবহাল মহলের অভিমত, সরকারি জনতা ব্যাংকের দায়দেনা, জালিয়াতি ও খেলাপি ঋণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পাশাপাশি পরিচালনা পর্ষদও দায়ী। বিশেষ করে, বড় আকারের যেসব ঋণ জালিয়াতি, অনিয়ম ও দুর্নীতি উদঘাটিত হয়েছে; তার পেছনে প্রভাবশালী পরিচালকদের হাত রয়েছে। শক্তভাবে তদন্ত হলে এতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত সবাইকে শনাক্ত করা যাবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি দুই ধরনের ব্যাংকেই অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা চিহ্নিত হয়েছে। দেখা যায়, এসবের জন্য ক্ষমতাসীন মহলের হস্তক্ষেপ ও প্রশ্রয় এবং তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বহুলাংশে দায়ী। ব্যাংকিং খাতের বেহাল দশা কাটছে না সরকারের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ না থাকায়। অথচ এ ব্যাপারে শীর্ষস্থানীয় নীতিনির্ধারকদের বাগাড়ম্বর চলছেই।
আমরা মনে করি, ব্যাংকগুলোর দুর্দশার দায় সরকার কিছুতেই এড়াতে পারে না। জনগণের রক্ত পানি করা কোটি কোটি টাকায় ‘সাদা হাতি’ পোষা এবং বিশেষত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ‘সাগরচুরি’ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement