২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
কোটা নিয়ে সরকারপক্ষের খোঁড়া যুক্তি

আইন বিশেষজ্ঞদের প্রত্যাখ্যান

-

সরকারপক্ষ বেশ কয়েক দিন ধরে সুপ্রিম কোর্টের একটি আদেশের কথা উল্লেখ করে বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটার কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না। কারণ, তা করা হলে সরকারকে আদালত অবমাননার দায়ে মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা তা থেকে ভিন্ন। কারণ, এটি ছিল আদালতের একটি পর্যবেক্ষণ মাত্র। এ পর্যবেক্ষণ মেনে চলা সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক নয়, এমনটিই বলছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
২০১৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এক রায়ে বলেন, ‘হাইকোর্ট বিভাগের পর্যবেক্ষণ হচ্ছেÑ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত ৩০ শতাংশ কোটা কঠোরভাবে মানতে হবে।’
জাজ, জুরি ও স্কলাররা বিশ্বজুড়ে দীর্ঘকাল আগেই মতামত দিয়েছেন। একটি রায়ে দেয়া অবজারভেশন (পর্যবেক্ষণ), যা বিচারকের রিমার্কস (মন্তব্য) বা ওপিনিয়ন (অভিমত) হিসেবেও পরিচিত, মামলার কোনো পক্ষের জন্য মেনে চলা বাধ্যতামূলক নয়।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদসহ অন্যান্য আইন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, এটি সুমীমাংসিত নীতি, যা আমাদের বিচারব্যবস্থায় দীর্ঘকাল ধরে অনুসরণ করা হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী এ কে এম মোজাম্মেল হক অবশ্য মনে করেন ভিন্ন কিছু। তিনি সুপ্রিম কোর্টের ‘অবজারভেশনকে (পর্যবেক্ষণ) একটি অর্ডার (আদেশ) হিসেবে দাবি করছেন এবং বলছেন, এটি সরকারের মেনে চলা বাধ্যতামূলক। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী কয়েক দিন আগে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ধারণাই প্রকাশ করেন। তিনি এ ৩০ শতাংশ কোটা পরিবর্তন করা যাবে না বলে জোরালো অভিমত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতিদের জন্য নির্ধারিত এ কোটা বলবৎ রাখা হবে। তাতে কোনো পরিবর্তন করা যাবে না। তিনি বলেন, আদালতের আদেশ অমান্য করে তাতে পরিবর্তন আনা হলে সরকার আদালত অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত হবে।
তার এ বক্তব্যের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর বক্তব্য উল্লেখ করে বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতিদের জন্য সংরক্ষিত কোটা সংস্কারের কোনো সুযোগ নেই। কারণ, হাইকোর্ট সিদ্ধান্ত দিয়েছেন এসব কোটা রাখার ব্যাপারে। অতএব আমরা কী করে এ রায়ের বিরুদ্ধে যেতে পারি? অবশ্য এর আগে এপ্রিল মাসে তিনি সংসদে ঘোষণা দিয়েছিলেন কোটাব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিলের।
বর্তমানে সরকারি চাকরির ৫৬ শতাংশ বিভিন্ন কোটার আওতায় নিয়োগ দেয়া হয়। ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতিদের জন্য, ১০ শতাংশ নারীদের জন্য, পিছিয়ে থাকা জেলাগুলোর অধিবাসীদের জন্য ১০ শতাংশ, উপজাতিদের জন্য ৫ শতাংশ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত।
এ কোটাপদ্ধতির বিরুদ্ধে সারা দেশের চাকরি প্রার্থীদের জন্য অসন্তুষ্টি থাকলেও সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রবল জোরদার হয়ে ওঠে। এ প্রেক্ষাপটেই গত এপ্রিলে সংসদে প্রধানমন্ত্রী কোটাব্যবস্থা না থাকার ঘোষণা দেন। কিন্তু তা বাস্তবায়নে অহেতুক বিলম্বের কারণে আবার কোটা আন্দোলনকারীরা এ ব্যাপারে আন্দোলনে নামার চেষ্টা করলে আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্রছাত্রীসহ তাদের নেতারা ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন। ছাত্রদের সমর্থনে কথা বলায় অনেক শিক্ষকও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে নাজেহাল হন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা পুলিশের নির্যাতন, আটক, রিমান্ড ও মামলার মুখে পড়েন। এরই মধ্যে সরকারপক্ষ উল্টো সুর নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতিদের কোটা বাতিল করা যাবে না, এমন খোঁড়া যুক্তি নিয়ে মাঠে নামে।
আমরা মনে করি, কোটা সংস্কার নিয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণকে আদেশ হিসেবে দাবি করা সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলবে। আশা করি, সরকার সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের যৌক্তিক দাবি মেনে নেয়ায় আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসবে। ভিন্ন পথে চললে সমস্যা শুধু বাড়বেই, কমবে না।


আরো সংবাদ



premium cement