১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কাগুজে আদায়ে তহবিল সঙ্কট বাড়ছে ব্যাংকে

কাগুজে আদায়ে তহবিল সঙ্কট বাড়ছে ব্যাংকে - ছবি : সংগৃহীত

ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করছেন না একশ্রেণীর ব্যবসায়ী। উপরন্তু ঋণ পরিশোধ না করেও কৃত্রিম আদায় দেখানো হচ্ছে নানা কৌশলে। এর ফলে নগদ আদায় অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে ব্যাংক খাতে। এতে জমে যাচ্ছে খেলাপি ঋণের পাহাড়। বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি দৈনন্দিন চাহিদাও মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কোনো কোনো ব্যাংককে। ব্যয়সঙ্কোচননীতি গ্রহণ করেও কুলাতে পারছে না ব্যাংকগুলো। কোনো কোনো ব্যাংক এ সঙ্কট মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার করে চলছে। এ দিকে উদ্যোক্তাদের চাপে বছর শেষে আয় ঠিক রাখতে কৃত্রিম উপায়ে মুনাফা বাড়ানোর বিকল্প নীতি গ্রহণ করেছে কোনো কোনো ব্যাংক। এমনি অবস্থা চলতে থাকলে সামনে ব্যাংকিং খাতের জন্য কঠিন সময় অপেক্ষা করছে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

দুর্বিষহ হয়ে উঠছে জীবন : আমদানি-রফতানি শাখায় একত্রে কাজ করতেন পাঁচজন। গত চার বছরে তাদের মধ্যে তিন কর্মকর্তা স্বাভাবিক অবসরে গেছেন। এর বিপরীতে নতুন একজনও নিয়োগ দেয়া হয়নি। ফলে পাঁচজনের কাজ দু’জনে করতে এখন গলদঘর্ম অবস্থা। সকালে অফিসে গিয়ে ছুটির পর আরো দুই ঘণ্টা কাজ করেও দিনের কাজ শেষ হয় না। ফলে রাতে বাসায়ও অফিসের কাজ করতে হয়। এতে ভুলত্রুটি হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। আর সবসময় আতঙ্কে থাকতে হয়। সামাজিক, পারিবারিক জীবন বলতে এখন আর তাদের কিছু নেই। না পারছেন চাকরি ছাড়তে, আর না পারছেন চাকরি নিয়মিত রাখতে। উভয় সঙ্কটে পড়েছেন তারা।

কথাগুলো বলছিলেন দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের ভুক্তভোগী কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ব্যাংক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, একে তো লোকবল সঙ্কট, তার সাথে ওপরের চাপÑ সব মিলিয়েই তাদের জীবন এখন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। ওই কর্মকর্তার মতো এখন বেশির ভাগ ব্যাংকারেরই একই অবস্থা। জানা গেছে, ব্যয়সঙ্কোচননীতি গ্রহণ করায় বেশির ভাগ ব্যাংকেই এখন আর প্রয়োজনীয় লোকবল নেয়া হচ্ছে না। বরং সামান্য ভুলেই চাকরি থেকে বিদায় করে দেয়া হচ্ছে। আবার কোনো কোনো ব্যাংক নানা কৌশলে লোকবল কমিয়ে ফেলছে। ২০ বছরের ওপরে চাকরির বয়স হলেই বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ফেলে তাদের চাকরি থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে।

মূল কারণ নগদ আদায় কমে যাওয়া : ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলোর এমন অবস্থার পেছনে অন্যতম কারণ হলো ব্যাংকগুলোতে নগদ আদায় কমে যাওয়া। কিছু কিছু ব্যাংকে নগদ আদায় অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত নেয়া হচ্ছে। কিন্তু মুষ্টিমেয় কিছু ব্যাংক উদ্যোক্তা নানা উপায়ে ঋণের নামে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ওই ঋণ আর আদায় হচ্ছে না। দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এখন আতঙ্কের কারণ হলো এজেন্ট ব্যাংকিং। গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ছে এ এজেন্ট ব্যাংকিং। সাধারণের কাছ থেকে আমানত নেয়া হচ্ছে। আর ওই আমানত ঋণের নামে চলে যাচ্ছে কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যবসায়ী গ্রুপের দখলে। কিন্তু তারা নানা কৌশল নিয়ে ওই অর্থ আর ফেরত দিচ্ছেন না। সামনে ওই সব ব্যবসায়ী গ্রুপের কিছু হলে ব্যাংকের সামগ্রিক অবস্থাই খারাপ হয়ে যাবে। এ কারণে তারা এখন ওই সব ব্যবসায়ী গ্রুপের মঙ্গলের জন্য দোয়া করছেন।

দুর্বল তদারকি দায়ী : ব্যাংকিং খাতে নগদ আদায় কমে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় বিশেষ ছাড় এবং দুর্বল তদারকি ব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছেন, ঋণখেলাপিদের নানা ফরম্যাটে ছাড় দেয়া হচ্ছে। কখনো ঋণ পুনর্গঠন, কখনো ২ শতাংশে ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণ নবায়ন আবার কখনো নয়-ছয় ফর্মুলা দেয়া হচ্ছে। এতে ব্যাংকে নগদ আদায়ের ওপর প্রভাব পড়ছে। যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন তারাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন ঋণ পরিশোধে। ফলে ব্যাংকিং খাতে প্রকৃত আদায় কমে গেছে। বাড়ছে কাগুজে আদায়।

তিনি বলেন, এর বাইরে যারা বিভিন্ন কায়দা-কানুন করে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে অর্থ বের করে নিচ্ছেন তাদের ব্যাপারেও কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এতে ব্যাংকিং খাতে সঙ্কট বেড়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (লিজিং) গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পাারছে না। ইতোমধ্যে কয়েকটি ব্যাংকেরও একই অবস্থা দেখা দিয়েছে।
ড. সালেহউদ্দিন বলেন, এ অবস্থা বেশি দিন চলতে পারবে না। ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের সঙ্কট দেখা দেবে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটরিং ও সুপারভিশন ব্যবস্থা জোরদার করা। ভালো ব্যাংকের রিওয়ার্ড ও মন্দ ব্যাংকের তিরস্কার করার ব্যবস্থা করতে হবে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরো শক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে হবে; অন্যথায় ব্যাংকিং খাতের সম্ভাব্য পরিণতির দায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এড়াতে পারবে না বলে তিনি মনে করেন।

নগদ আদায় কমার উদ্বেগজনক চিত্র : নগদ আদায় কমে যাওয়ার ভয়াবহচিত্র পাওয়া যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানেই। সর্বশেষ সেপ্টেম্বরভিত্তিক এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, আদায় অযোগ্য অবলোপনকৃত ৪১ হাজার ১৭৭ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে তিন মাসে আদায় হয়েছে মাত্র ১৩৯ কোটি টাকা, যা মোট অবলোপন ঋণের মাত্র শূন্য দশমিক ৩৪ শতাংশ। আর অবলোপনসহ মোট এক লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে আদায় হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ।

এ দিকে নয়-ছয়ের চক্করে পরে ব্যাংকে আমানত প্রবাহ কমে যাচ্ছে। ব্যাংকের আমানত মূলত সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিসংখ্যান মতে, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফাইন্যান্সিয়াল করপোরেশনসহ স্ব-শাসিত এমন প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৬৮টি। বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় সোয়া দুই লাখ কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে স্থিতি আছে। এসব সরকারি আমানতই এখন কোনো কোনো ব্যাংকের প্রধান ভরসা হয়ে গেছে। সরকারি আমানত কোনো ব্যাংক থেকে প্রত্যাহার করে নিলেও ওই ব্যাংকের ঋণ আমানতের অনুপাত (এডি রেশিও) ব্যাপকভিত্তিতে বেড়ে যাবে। এমন আশঙ্কায় আছে কিছু কিছু ব্যাংক।

বাড়ছে মূলধন ও প্রভিশন ঘাটতি : নগদ আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোয় এক দিকে যেমন প্রকৃত খেলাপি ঋণ বাড়ছে তেমনি বাড়ছে মূলধন ও প্রভিশন ঘাটতি। এ কারণে ব্যাংকগুলো নানা উপায়ে পরিচালন মুনাফা দেখাছে। যেমন- অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। কিন্তু এখানে প্রভিশন না রেখে অর্জিত আয় মুনাফায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আবার মন্দ মানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে অর্জিত আয় স্থগিত রাখতে হয়; অর্থাৎ আয় খাতে নেয়া যায় না এ ধরনের মুনাফা। কিন্তু তদারকির দুর্বলতার কারণে এসব আয়ও মুনাফা হিসেবে দেখাচ্ছে কিছু কিছু ব্যাংক।

আবার কিছু কিছু ব্যাংকে প্রভিশন বাকিতে রেখে ওই প্রভিশনের অর্থ আয় খাতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিছু কিছু ব্যাংক নগদ আদায় না করেই ওই ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ আয় খাতে নিয়ে যাচ্ছে। সব মিলেও কৃত্রিম আদায়ের ওপর ভিত্তি করে কৃত্রিম মুনাফা করছে। এতে ব্যাংকে দীর্ঘ মেয়াদে সঙ্কট বেড়ে যাচ্ছে বলে ব্যাংকাররা মনে করছেন। সামনে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।


আরো সংবাদ



premium cement