২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

নাব্যতা ফেরানোর নামে নদীতে হাজার হাজার কোটি টাকা

নাব্যতা ফেরানোর নামে নদীতে হাজার হাজার কোটি টাকা - ছবি : সংগৃহীত

নদীর নাব্যতা ফেরানো, নদী খনন, তীর রক্ষা, তীর সংরক্ষণের নামে নদীর পেটেই যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। কিন্তু তাতে কোনো সুফল আসছে না। দিন দিন নদীপথের পরিমাণ যে হারে হ্রাস পাচ্ছে তাতে জরুরি ভিত্তিতে নৌ-পথগুলো ড্রেজিং করা না হলে অচিরেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু নাব্যতা বাড়ানোর জন্য ড্রেজিং কার্যক্রম নিয়েও তা নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়াতে জটিলতা বাড়ছে। বড় ধরনের অর্থ ব্যয়ে এই খনন প্রকল্প চলমান থাকার পরও প্রায় পৌনে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ঝিনাই, ঘাঘট, বংশী ও নাগদা নদীর নাব্যতা ফেরাতে প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো উইং বলছে, বড় ব্যয়ে ৫৩টি নৌপথে ক্যাপিটাল ড্রেজিংসহ নদী খনন নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রকল্প চলমান আছে। এরপরও এত বড় অঙ্কের জিওবি টাকায় নদী খনন প্রকল্প গ্রহণ করা ঠিক হবে না। এটা বৈদেশিক সহায়তায় ছোট ছোট প্রকল্প করা যেতে পারে। 

নদী রক্ষা কমিশনের এক তথ্যানুযায়ী, নদীমাতৃক এই বাংলাদেশে ছোট-বড় ও মাঝারি আকারের প্রায় সাড়ে ৭০০টি নদী রয়েছে। কিন্তুড্রেজিং ও অপরিকল্পিত হস্তক্ষেপের কারণে দেশের প্রায় ২৩০টি নদী এখন মৃত। বর্তমানে নদীগুলো পলিউশন, সিলটেশন, তীর দখল, ব্লকেজ ইত্যাদির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার বেশির ভাগ শিল্প নদীর তীর ঘেঁষে স্থাপন করায় প্রতিদিন ১০০ টন শিল্পের বর্জ্য নদীতে পড়ছে। বাংলাদেশে সর্বমোট ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌ-যোগাযোগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যার মধ্যে আট হাজার কিলোমিটার নৌবহর ছিল ১৯৬৩ সালে যা বাংলাদেশের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। ১৯৮৯ সালে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডিএইচভি অ্যাসোসিয়েট যখন ব্যাপক জরিপ করে তখন নৌপথের নাব্যতা কমে ছয় হাজার কিলোমিটার হয়। এই নদীগুলোর দ্বারা প্রতি বছর বন্যায় ৫০ লাখ কিউসেক পানি এবং ২৪০ কোটি টন পলি পরিবাহিত হয়। যা সমগ্র বিশ্বের পরিবাহিত পলির সাড়ে ১৮ শতাংশ। ফলে নদীগুলো ক্রমান্বয়ে মৃত হয়ে পড়েছে। নাব্য নৌপথের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। তবে ১৯৮৯ সলের পর আর কোনো জরিপ না পাওয়ায় বর্তমানে নদীর দৈর্ঘ্যরে কোনো দাফতরিক হিসাব নেই। পানি প্রবাহ হ্রাস, ক্রস-বাউন্ডারি প্রবাহ হ্রাস, পলিপ্রবাহ বৃদ্ধি এবং জোয়ারের প্রবাহ কম ইত্যাদি কারণে নদীগুলো নাব্যতা হারাচ্ছে। 

জানা গেছে, বাংলাদেশ ইন্টেগ্রেটেড ট্রান্সপোর্ট সেক্টর স্টাডি ১৯৯৮ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী নাব্য নৌপথের পরিমাণ বর্ষাকালে ছয় হাজার কিলোমিটার এবং শুকনো মওসুমে তিন হাজার ৮০০ কিলোমিটার, যা স্বাধীনতার আগে ছিল যথাক্রমে আট হাজার ৪০০ কিলোমিটার এবং পাঁচ হাজার ২০০ কিলোমিটার। এই প্রবাহ কমে যাওয়ায় একদিকে মাছের উৎপাদন এবং সেচ কার্যক্রম ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। 

পিইসির তথ্যানুযায়ী, ঝিনাই, ঘাঘট, বংশী ও নাগদা নদীর নাব্যতা ফিরাতে ৪ হাজার ৭৮৬ কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্প প্রস্তাব করেছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। এখানে ঝিনাই ও বংশী নদীর জন্য খনন ব্যয় ২ হাজার ৩৪২ কোটি ৮ লাখ ৫৩ হাজার টাকা, ঘাঘট নদীর জন্য ১ হাজার ৩৩০ কোটি ১ লাখ ৫৯ হাজার টাকা ও নাগদা নদীর জন্য ১ হাজার ১১৪ কোটি ১৫ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃক ড্রেজিং কাজ বাস্তবায়নের জন্য সরকারি অনুদানে বেশ কয়েকটি প্রকল্প ইতোমধ্যে অনুমোদিত হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ৪ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা ব্যয়ে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তুলাই এবং পুনর্ভরা নদীর নাব্যতা উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প ও ৮৪৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদীর তীর রক্ষা ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ। 

অভ্যন্তরীণ নৌপথের ৫৩টি রুটে ক্যাপিটার ড্রেজিং (প্রথম-২৪টি রুটে) কার্যক্রম এক হাজার ৯২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১২ সালে অনুমোদন দেয় হয়। এটি ২০১৮ সালের জুনে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু সেটা করতে পারেনি বাস্তবায়নকারী সংস্থা বিআইডব্লিউটিএ। নদীগুলোর নাব্যতা আনতে ৫৩টি রুটের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ২৪টি রুটে ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু হয়েছে। রুটগুলো হচ্ছে ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ-গজারিয়া-চাঁদপুর-চট্টগ্রাম পথ, চাঁদপুর-হিজলা-বরিশাল নৌপথ, গাশিয়াখালী-বরিশাল-কালীগঞ্জ-চাঁদপুর-আরিচা নৌপথ, ভৈরববাজার-লিপসা-চটক-সিলেট নৌপথ, গাজলাজর-মোহনগঞ্জ নৌপথ, লোয়ারগা-দুলোভপুর নৌপথ, চিটরি-নবীনগর-কুটিবাজার নৌপথ, নরসিংদী-কাটিয়াদী নৌপথ, নরসিংদী-মরিচাকান্দি-সেলিমগঞ্জ-বাঞ্ছারামপুর-হোমনা নৌপথ, দাউদকান্দি-হোমনা-রামকৃষ্ণপুর পথ, চাঁদপুর-ইচলি-ফরিদগঞ্জ নৌপথ, বরিশাল-ঝালকাঠি-পাথরঘাটা নৌপথ, খুলনা-গাজিরহাট-মানিকদা নৌপথ, নন্দীবাজার-মাদারীপুর নৌপথ, দিলালপুর-গৌরাদিঘার-চামড়াঘাট-নীলকিয়াটপাড়া-নেত্রকোনা নৌপথ, মনুমুখ-মৌলভীবাজার নৌপথ, মিরপুর-সাভার নৌপথ, শ্রীপুর-ভোলা খেয়াঘাট-গঙ্গাপুর-ভোলা নৌপথ, চৌকিঘাটা-কালীগঞ্জ পথ, পটুয়াখালী-মীর্জাগঞ্জ নৌপথ, হোসনাবাদ-টরকী-ফাঁসিতলা নৌপথ, দালারচর-বালিয়াকান্দি-বোয়ালমারী-কাশিয়ানি নৌপথ ইত্যাদি।

পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ আপত্তি জানিয়ে বলছে, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের চলতি ২০১৯-২০ অর্থ বছরে চলমান ৪৮টি প্রকল্প রয়েছে যা বাস্তবায়নে তিন হাজার ১৩১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কিছু নতুন প্রকল্প ইতোমধ্যে পিইসি থেকে সুপারিশ করা হয়েছে। ফলে আরএডিপিতে চাহিদা আরো বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় চারটি নদীপথ খননের মতো বিরাট অর্থ ব্যয়ের প্রকল্প যৌক্তিক নয়। এ ছাড়া যেখানে চলমান ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ে প্রতি ঘনমিটারে সরকারি ড্রেজার দিয়ে খননে ব্যয় হবে ১২০ টাকা এবং বেসরকারি ড্রেজার দিয়ে ব্যয় হচ্ছে ১৫০ টাকা, সেখানে প্রস্তাবিত প্রকল্পে এই ব্যয় ১৯০ টাকা ধরা হয়েছে। যা ৭০ টাকা বেশি। অন্যদিকে মাটির ডাই নির্মাণ ব্যয় প্রতি ঘনমিটারে ১০০ থেকে ১৪০ টাকা ধরা হয়েছে। কিন্তু চলমান দুটি প্রকল্পে এই ব্যয় ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ে ৪২ টাকা এবং গোপালগঞ্জের নৌপথ খনন প্রকল্পে ৪৫ টাকা।


আরো সংবাদ



premium cement