১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
ড. মুস্তফা কে মুজেরির বাজেট মূল্যায়ন

‘গতানুগতিক তবে আকারটা বড়’

‘গতানুগতিক তবে আকারটা বড়’ - সংগৃহীত

তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসা সরকারের নতুন অর্থমন্ত্রীর প্রথম প্রস্তাবিত বাজেটটি হলো গতানুগতিক তবে আকারটা বড়। নতুন অর্থমন্ত্রীর কাছে দেশের মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল। বাজেটে গুণগত পরিবর্তনের যে প্রত্যাশা করা হয়েছিল সেটা দেখা যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ও ইনস্টিটিউট অব ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরি। তিনি বলেন, রাজস্ব আদায়ে পুরনো ধারার সার্বিক পরিবর্তন না হলে বাজেটের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা অর্জন হবে না। 

প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর গতকাল বৃহস্পতিবার অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে এই মন্তব্য করেন অর্থনীতিবিদ ড. এম কে মুজেরি। 

সোয়া তিন লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার ব্যাপারে ড. এম কে মুজেরি বলেন, এনবিআর বা অন্যান্য খাতে যেভাবে রাজস্ব আদায় করা হচ্ছে সেই ধারা অব্যাহত থাকলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে না। এনবিআর, এনবিআরবহির্ভূত ও অন্যান্য খাত থেকে সরকার রাজস্ব আহরণের বিরাট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। চলতি অর্থবছর যে লক্ষ্যমাত্রা নির্দারণ করা হয়েছিল, তাতেও অনেক ঘাটতি রয়েছে। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রায় তা কমিয়ে আনা হয়েছে। সেটাও অর্জন করা সম্ভব হবে না। আদায়ের একই ধারা অব্যাহত রেখে যদি আমরা আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে অগ্রসর হই তাহলে সেটা অর্জন করা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, রাজস্ব আদায়ের ধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। আধুনিকায়ন ঘটাতে হবে। এ ক্ষেত্রে অনেক ফাঁকফোকর আছে। এসব বন্ধ করতে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো সরকারের তেমন প্রস্তুতি ও সৎ সাহস আছে কি না সেটা দেখতে হবে। 

বাজেটে ঘাটতি অর্থায়নের ব্যাপারে তিনি বলেন, বিরাট আকারের ঘাটতি অর্থায়নের বড় অংশ আসবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। এ জন্য ধরা হয়েছে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। আর ব্যাংকিং খাত থেকে নেয়া হবে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। দুর্বল ব্যাংকিং খাত থেকে এই অর্থ নেয়া হবে। আমাদের ব্যাংকিং খাত দুর্বল। 

এই খাতটি সমস্যায় জর্জরিত। সমস্যা থেকে খাতটি বের হতে পারছে না। এই পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং খাত থেকে অর্থায়নে চাপ দেয়া হলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের বেসরকারি খাতে। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেয়ার ক্ষমতা কমে গেছে। ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা দূর করা তথা, সার্বিকভাবে অবস্থার পরিবর্তন না হলে বাজেটের উচ্চাভিলাসী পরিকল্পনা অর্জন হবে না। 

বাজেটে প্রস্তাবিত দুই লাখ দুই হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ব্যাপারে ড. মুজেরি বলেন, প্রতি বছরই আমাদের এডিপির আকার বড় হচ্ছে। কিন্তু আমাদের এডিপির আকার বড় করার আগে দেখতে হবে এটা বাস্তবায়ন করার সক্ষমতা কতটা আছে। যেভাবে আমরা আকার বাড়াচ্ছি তা কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কারণ আমাদের সক্ষমতা সীমিত এবং তা বাড়েনি। এই বাস্তবায়ন সক্ষমতা বাড়ানো না হলে এটা অর্জন করা সম্ভব হবে না। 

মুজেরির মতে, বাজেট বাস্তবায়নের উদ্যোগ যদি না নেয়া হয় তাহলে পরিকল্পনাই থাকবে। আমাদের ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়নি। সেটাকে বাড়াতে হবে। কৃষি খাতে আমাদের অনেক সমস্যা রয়েছে। সেইসব সমস্যা আমরা দূর করতে পারিনি। বাজেটে এই সমস্যা দূর করতে তেমন কোনো বরাদ্দ নেই। গতানুগতিকভাবে যে বরাদ্দ দেয়া হয় সেটাই রাখা হয়েছে। আমাদের উচিত কৃষি ও কৃষককে উৎসাহিত করতে বিশেষ নজর দেয়া। এবার বোরো উৎপাদন ভালো হয়েছে কিন্তু কৃষক ফসলের প্রকৃত মূল্য পায়নি। প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষকের সমস্যা উত্তরণের পদক্ষেপ নেই। 

বিআইডিএসের সাবেক এই ডিজি বলেন, নতুন অর্থমন্ত্রীর প্রথম বাজেট। দেশের মানুষের প্রত্যাশাটা বেশি ছিল তার কাছে। সবাই প্রত্যাশা করেছিল বাজেটে একটা গুণগত পরিবর্তন দেখা যাবে। অনেকটা নতুনত্ব আসবে। কিন্তু সবাই হতাশ। সে পরিবর্তনটা আমরা দেখতে পাইনি। সেই গতানুগতিক বাজেটই দেয়া হয়েছে। দেশের অর্থনীতিকে নতুন আঙ্গিকে নেয়ার জন্য তেমন কোনো সিদ্ধান্ত দেখতে পাইনি বাজেট বক্তৃতায়। অবশ্য আকারটা বড়, এটা স্বীকার করতে হবে। এটাও দরকার ছিল। 

প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্কে পণ্য বা সেবা উৎপাদনজনিত আয়কে ১০ বছরের জন্য বিভিন্ন হারে কর অব্যাহতি সুবিধা দেয়া হয়েছে। বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য অথনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে শিল্প স্থাপনে অপ্রদর্শিত আয় থেকে বিনিয়োগকৃত অর্থের উপর ১০ শতাংশ হারে কর প্রদান করা হলে উক্ত অর্থের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। কালো টাকা সাদা করার জন্য প্রতিবারের মতো এবারো সুযোগ দেয়া হয়েছে এটা নতুন কিছু না বলে মন্তব্য করেন ড. এম কে মুজেরি। তার বিশ্লেষণ, এটা কয়েক বছর ধরে দেয়া হচ্ছে। তবে সাদা খুব একটা হয়েছে বলে মনে হয় না। এবারো যে কতটা হবে তা নিয়ে আমার সংশয় রয়েছে। এই সুযোগে তারা উৎসাহিত নয়। প্রতিবছর প্রচুর কালো টাকা হচ্ছে। তা বন্ধ করা উচিত। এই সব সুযোগে তেমন কোনো কাজ হচ্ছে না। ফলপ্রসূ কোনো লাভ পাচ্ছি না। কালো টাকার ফাঁকগুলো বন্ধ করতে উদ্যোগ নিতে হবে। সে ব্যাপারে নজর দিতে হবে। 

ব্যক্তি করমুক্ত আয়ের সীমার ব্যাপারে মুজেরি বলেন, আড়াই লাখ টাকা করমুক্ত আয়ের সীমা কয়েক বছর ধরেই বহাল রয়েছে। কোনো পরিবর্তন করা হচ্ছে না। সীমার আকারটা বাড়ানো হলে অনেক মানুষ যারা কর দিচ্ছে তারা হয়তো নেট থেকে বের হয়ে যাবে, তাই হয়তো করা হচ্ছে না। কিন্তু গত তিন বছর আগের আড়াই লাখ টাকা আর এখনকার আড়াই লাখ টাকার মান সমান না। মূল্যস্ফীতির কারণে এটা কমে গেছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে।


আরো সংবাদ



premium cement