২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ওয়ারিশদের বহন করতে হবে ঋণখেলাপির দায়

ওয়ারিশদের বহন করতে হবে ঋণখেলাপির দায় - সংগৃহীত

আগামীতে ঋণখেলাপির মৃত্যু হলে খেলাপি ঋণের দায়ভার তার উত্তরাধিকার বা ওয়ারিশদেরই বহন করতে হবে। শুধু তাই নয়, ২৫ কোটি টাকার বেশি সব খেলাপি ঋণের মামলাকে ফাস্ট ট্র্যাকেও (অগ্রাধিকার খাত) অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ঋণখেলাপি মামলা চলাকালে বন্ধকী সম্পত্তি নিলামে উঠানো হবে। একই সাথে খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত কোনো মামলায় উচ্চ আদালতে রিট করতে হলে ঋণের ২৫ শতাংশ অর্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে জমা দিয়েই শুধু রিট মামলা করা যাবে। ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের জন্য বিদ্যমান অর্থঋণ আদালত আইন পরিবর্তনের বিষয়ে এ সুপারিশ করেছে অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। ২৩ পৃষ্ঠার এই সুপারিশের ওপর মতামত দেয়ার জন্য তা গেল সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সুপারিশে উল্লেখ করা হয়, অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ এর ৩৪(২) ধারা মতে, ঋণগ্রহীতার মৃত্যুর কারণে পারিবারিক উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী স্থলাভিষিক্ত দায়িক ওয়ারিশদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। এটি সংশোধন করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সুপারিশ হচ্ছে, যেহেতু উত্তরাধিকারী ঋণখেলাপির সম্পদ ভোগ করবে। তাই দায়ও তার। এ জন্য ৩৪(২) ধারাটি সংশোধন করে উত্তরাধিকারীরা ঋণগ্রহীতার দায় নেবেন উল্লেখ করে সংশোধনী আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। 

সংশোধনীর সুপারিশে আরো বলা হয়েছে, ২৫ কোটি টাকার বেশি মূল্যমানের মামলা ফাস্ট ট্র্যাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়েরের পর সে আইনের অধীনে মেডিয়েশনের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির চেষ্টা প্রায় ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। কারণ, মামলা দায়েরের আগেই বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি অধিকতর কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ ক্ষেত্রে বড় অংকের ঋণগ্রহীতা অর্থাৎ ৫ কোটি টাকার বেশি স্থিতিসম্পন্ন ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের আগে নিবন্ধনকৃত প্রতিষ্ঠানের তদারকিতে পেশাদার মেডিয়েটরদের নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে মেডিয়েশনের প্রচেষ্টা এবং তৎপরতা চালানো বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। পাশাপাশি যেসব দেওয়ানি মামলা (যার মূল্য ২৫ কোটি টাকার কম) মামলা পূর্ববর্তী মেডিয়েশনের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যায়নি তা নিবন্ধনকৃত প্রতিষ্ঠানের তদারকির মাধ্যমে পেশাদার আরবিট্রেটর নিয়োগ করে নিষ্পত্তির জন্য বাধ্যতামূলকভাবে পাঠানো যেতে পারে। এসব আরবিট্রেশন প্রক্রিয়া ফাস্ট ট্র্যাক সোল আরবিট্রেটরের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যেতে পারে। আর নিষ্পত্তির জন্য একটা যৌক্তিক সময়সীমা বেঁধে দেয়া যেতে পারে। একইভাবে ২৫ কোটি টাকার বেশি মূল্যমানের মামলা ফাস্ট ট্র্যাকের আওতায় আদালতের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করার বিধান করা যেতে পারে উল্লেখ করে অর্থঋণ আদালত আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা পরিবর্তন প্রয়োজন। 

আইন সংশোধনীর প্রস্তাবে বলা হয়েছে, অর্থঋণ আদালতে মামলার অবস্থা যা-ই থাক না কেন প্রয়োজনে বন্ধকী সম্পত্তি নিলাম করা যাবে। বর্তমান চলমান অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ এর ১২ ধারায় মামলা পূর্ববর্তী পর্যায়ে এবং ৩৩ ধারায় মামলার রায় হওয়ার পর নিলামের ব্যাপারে বলা আছে; কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে মামলার মধ্যবর্তী পর্যায়ে বন্ধকী সম্পত্তি নিলামের প্রয়োজন পড়ে। আইনে এ বিষয়টি উল্লেখ না থাকায় তা করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে যেকোনো পক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে, অর্থঋণ আদালত তার নিজস্ব বিবেচনায় সঠিক ও যথাযথ মনে করলে মামলার যেকোনো পর্যায়ে বন্ধকী সম্পত্তি নিলামের আবেদন মঞ্জুর করার ধারা সংযোজন করা যেতে পারে।

কোনো কোনো গ্রাহক অর্থঋণ মামলায় অন্তর্বর্তী আদেশ বা তুচ্ছ অজুহাতে রিট মামলা দায়ের করেন। এতে ব্যাংকের ঋণ আদায় অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। এ জটিলতা কাটাতে মন্ত্রণালয় বলছে, একটি অর্থঋণ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে কোনোভাবেই যেন একাধিক রিট মামলা না করা যায় সে জন্য আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধন করা প্রয়োজন। অর্থ মন্ত্রণালয় রিট মামলার ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণের একটি নির্দিষ্ট অংশ (কমপক্ষে ২৫ শতাংশ) ব্যাংকে জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করার পক্ষে মত দিয়েছে। 

এ ছাড়া অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩ এবং সর্বশেষ সংশোধনী ২০১০ মোতাবেক আদালত কর্তৃক সুদ মওকুফের কোনো বিধান না থাকার পরও ডিক্রি বা রায় দেয়ার সময় মামলা পরবর্তী সুদ আরোপযোগ্য নয় মর্মে আদেশ দেন। এতে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আপিল দায়ের করে। ফলে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা হয়। এই অবস্থা নিরসনে মন্ত্রণালয়, অর্থঋণ মামলা বিচারিক আদালত কোনো পর্যায়েই ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত ঋণের সুদ মওকুফ বা সুদ আরোপ না করা বা আরোপযোগ্য নয় মর্মে কোনো রায় বা আদেশ দেবে না এমন বিধান সংযোজনের পক্ষে মত দিয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বরাবরে আদালত প্রদত্ত রায় ডিক্রিতে মামলা পরবর্তী সুদ প্রয়োগযোগ্য হবে মর্মে উল্লেখ না থাকলেও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রচলিত হারে সুদ আরোপ করতে পারবে বলেও মত দিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। 

এর আগে দায়িত্বভার নিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ব্যাংকিং খাতে বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার উপায় নির্ধারণের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সে মোতাবেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। 

জানা গেছে, দেশের মোট খেলাপি ঋণের চেয়েও বেশি পরিমাণ অর্থ আটকে আছে অর্থঋণ আদালতে। দেশের ৬৪ জেলায় অর্থঋণ আদালতে ৫৭ হাজার ৪১৬টি মামলা চলমান রয়েছে। এসব মামলায় জড়িত অর্থের পরিমাণ ১ লাখ ১০ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা। বড় ঋণখেলাপিরা উচ্চ আদালতে রিট করে স্থগিতাদেশ নিয়ে অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নেন। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব রিট মামলার সংখ্যা ৫ হাজার ৩৭৬টি। জড়িত অর্থের পরিমাণ ৫২ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। বিষয়গুলো উল্লেখ করে অর্থঋণ আদালত আইন সংশোধনের ওপর জোর দিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত পেলে আইনটি সংশোধনীর বিষয়ে অনুমোদন নেয়ার জন্য অর্থমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। চলতি মাসেই এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর সম্মতি পাওয়া যেতে পারে। এরপর তা ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হবে। পরবর্তীতে আইন মন্ত্রণালয় থেকে এই সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাঠানো হবে।


আরো সংবাদ



premium cement