১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নানামুখী সঙ্কটে অর্থনীতি

- ফাইল ছবি

আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে ডলারের চাহিদা। কিন্তু কাক্সিক্ষত হারে সরবরাহ না বাড়ায় বাড়ছে ডলারের দাম। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় পণ্য আমদানিতে ব্যয় বেড়েই চলছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে মূল্যস্ফীতি তথা জীবনযাত্রার ব্যয়ের ওপর। অন্য দিকে নতুন বছরের শুরুতেই নতুন সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়ে গেছে।

কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে আমানতের সুদহার কম থাকায় কমে গেছে আমানতের প্রবৃদ্ধি। এর প্রভাব পড়েছে তারল্যের ওপর। ব্যাংকগুলোতে এখন বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ সঙ্কট মেটাতে ব্যাংকগুলো আবার আমানতের সুদ হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর আমানতের সুদ হার বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে ঋণের সুদ। আর ঋণের সুদ হার বেড়ে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়ছে বিনিয়োগের ওপর।

এদিকে ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) দেয়া নয়-ছয় সুদহার দীর্ঘ সাত মাসেও বাস্তবায়ন হয়নি। এ ত্রিমুখী চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে আগামী ছয় মাসের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মুদ্রানীতি প্রণয়নের সাথে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে এবারের মুদ্রানীতি। এ বিষয়ে মতামত নেয়ার কাজ শুরু হয়েছে। চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের শুরু থেকেই ডলারের সঙ্কট দেখা দিতে শুরু করে। ব্যাংকগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণ তহবিলের সংস্থান না করেই অস্বাভাবিকভাবে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে থাকে। এর পাশাপাশি অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে ডলার বিনিয়োগ করতে থাকে। ফলে নভেম্বর/ডিসেম্বর মাসে এলসির দায় পরিশোধ করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে যায় ব্যাংকগুলো।

আগে উদ্বৃত্ত ডলার বিক্রি করতে না পেরে যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকে বিনিয়োগ করত, সেখানে নিজেরা ডলার সঙ্কট মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এখন হাত পাতছে। এ অবস্থায় বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করতে হচ্ছে। এর ফলে কমে যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত বছরের ৯ জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল তিন হাজার ২০৭ কোটি ডলার। গত ৯ জানুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ১০০ কোটি ডলারে। তাও আবার আকিজ গ্রুপের শেয়ার বিক্রির বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসায় এ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এ অবস্থায় এসেছে। অন্যথায় রিজার্ভ তিন হাজার কোটি ডলারের নিচে নেমে যেত।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার পাশাপাশি বাড়ছে ডলারের দাম। গত বছরের জানুয়ারিতে যেখানে প্রতি ডলার পেতে ব্যয় হতো ৮২ টাকা, চলতি বছরের ৯ জানুয়ারিতে তা বেড়ে হয় ৮৪ টাকা। তবে ব্যাংকগুলোতে আরো বেশি দামে ডলার কেনা বেচা হচ্ছে। ডলার সঙ্কট মেটাতে কোনো কোনো ব্যাংক ৮৬ টাকা পর্যন্ত ডলার কিনছে। ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে আমদানি ব্যয়ের ওপর। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে চলছে। এতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আগামী মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ রাখাই কৌশলই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোকে ডলার সরবরাহ করলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর চাপ বেড়ে যাবে। আবার রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ না করলে ডলারের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাবে। আগামী মুদ্রানীতিকে সামনে রেখে এটি সমন্বয় করা কৌশল নির্ধারণ করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

এদিকে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণগ্রহণ বেড়েই চলেছে। সাধারণত প্রতি সপ্তাহে দুই দিন ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়ার জন্য নিলামের আয়োজন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে প্রায় প্রতিদিনই ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ গ্রহণ করে সরকার। এ কারণে প্রায় প্রতিদিনই নিলামের আয়োজন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের চাপ অব্যাহত রয়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার অনির্ধারিত দিনেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণের জোগান দেয়ার জন্য নিলামের আয়োজন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না হলে এবং কাক্সিক্ষত হারে বৈদেশিক ঋণ না পাওয়া গেলে আর সেই সাথে সরকারের ব্যয় না কমালে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ আরো বেড়ে যাবে। সব কিছু বিবেচনা করে আগামী মুদ্রা নীতিতে সরকারের অতিমাত্রায় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণকে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত কয়েক বছর ধরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ব্যাংক ঋণ নিয়েছে সরকার। কিন্তু নতুন বছরের শুরুতে বিশেষ করে গত ডিসেম্বর থেকে সরকার বেশি মাত্রায় ব্যাংক ঋণ নিচ্ছে। সরকার বেশি মাত্রায় ঋণ নিলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। এরই মধ্যে কিছু কিছু ব্যাংকের টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এতে বেড়ে গেছে আমানতের সুদ হার। আর আমানতের সুদ হার বেড়ে গেলে ঋণের সুদ হারও বেড়ে যাবে। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে বিনিয়োগের ওপর। এমনি পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ চ্যানেল সচল রাখাও হবে নতুন চ্যালেঞ্জ।

সাম্প্রতিক সময়ে নয়-ছয় সুদহার নিয়েও ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের সংগঠন ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছিল গত ১ জুলাই থেকে ঋণের সুদ হার হবে ৯ শতাংশ এবং তিন মাস মেয়াদি আমানতের সুদ হার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। গত বছরের ২০ জুন এ ঘোষণা দিয়েছিলেন বিএবি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। 

তার এ ঘোষণার পর কিছু কিছু ব্যাংক ঋণের সুদ হার না কমালেও আমানতের সুদ হার রাতারাতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনে। যেসব ব্যাংক আমানতের সুদ হার ৬ শতাংশে নামিয়ে এনেছিল পরে ওই সব ব্যাংক পড়ে মহাবিপাকে। একদিকে সঞ্চয়পত্রের সুদ হার সাড়ে ১১ শতাংশ, অন্য দিকে বেশির ভাগ ব্যাংক বিএবির এ নয়-ছয় সুদ হার না মানায় আমানতকারীরা সুদ হার কমিয়ে এনেছিল ওই সব ব্যাংক থেকে বেশি মুনাফার আশায় আমানত প্রত্যাহার করতে থাকে গ্রাহকেরা। 

হঠাৎ করে আমানত প্রত্যাহার হওয়ায় ব্যাংকগুলো পড়ে যায় মহাবিপাকে। আমানতের সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করায় কোনো কোনো ব্যাংক কলমানি মার্কেটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে বছরের শেষ সময়ে এসে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোকে রেপো ও বিশেষ তারল্য সহায়তার আওতায় প্রতিদিনই এক হাজার কোটি টাকা থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ধার দেয়। আর এ পরিস্থিতিতে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহে মরিয়া হয়ে উঠে।

এতে আমানতের সুদ হার কোনো কোনো ব্যাংকের ৬ শতাংশ থেকে এক লাফে ১০ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশে উঠে গেছে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ঋণের সুদ হার অচিরেই আবারো ১৮ থেকে ২০ শতাংশে গিয়ে ঠেকতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে এক ত্রিমুখী চ্যালেঞ্জের দুষ্টচক্রে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। আর এতগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। 

গাজীপুর সংবাদদাতা জানান, গাজীপুরে গতকাল পঞ্চম দিনের মতো পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন অব্যাহত ছিল। বিভিন্ন দাবিতে কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা কর্মবিরতি, বিক্ষোভ, অবরোধ ও ভাঙচুর করেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কয়েক রাউন্ড টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। শ্রমিক অসন্তোষের মুখে গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গী, ভোগড়া ও আশপাশের এলাকার অন্তত ১৫টি কারখানা ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। 

মহানগরের গাছা থানার ওসি মো: ইসমাইল হোসেন জানান, ভোগড়া এলাকার এ্যাপারেলস প্লাস নামে একটি কারখানায় দুপুরে শ্রমিকদের বেতন দেয়ার কথা ছিল। কর্তৃপক্ষ পুরনো বেতনকাঠামো অনুসারে বেতন দেয়া শুরু করলে শ্রমিকেরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। তারা নতুন বেতনকাঠামো অনুসারে বেতনের দাবি জানিয়ে কারখানা প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন।

একপর্যায়ে তারা কারখানা থেকে বের হয়ে মিছিল সহকারে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে গিয়ে অবরোধের চেষ্টা করেন। এ সময় বিক্ষোভকারীরা মহাসড়কে চলাচলকারী যানবাহনে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকলে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। একই দাবিতে চান্দনা চৌরাস্তা, বড় বাড়ি এলাকায় বিক্ষোভ করে কয়েক শ’ শ্রমিক। তবে পুলিশের হস্তক্ষেপে তারা মহাসড়কে দাঁড়াতে পারেননি।


আরো সংবাদ



premium cement