২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`
তিন দশকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি- পর্ব ১০

ইলিশের ৩ গুণ দাম রুই মাছের!

-

১৯৯০ সালে মাঝারি আকারের এক কেজি রুই মাছের দাম ছিল ১৪৫ টাকা। আর মাঝারি আকারের এক কেজি ইলিশ মাছের দাম ছিল মাত্র ৫০ টাকা। কয়েক বছর আগেও ইলিশের যে আকাশছোঁয়া দাম ছিল তাতে এটি শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটি শুধু যে সত্য তা নয় বরং অনেক বছর ধরেই রুই মাছের বিপরীতে ইলিশ মাছের দাম অনেক কম ছিল। পরবর্তীতে চাষের রুই মাছসহ আরো বিভিন্ন ধরনের চাষের মাছ বাজারে আসায় ধীরে ধীরে কমতে থাকে রুই মাছের দাম। আর বিপরীতে বাড়তে থাকে ইলিশ মাছের দাম। এক সময় ইলিশের দাম এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, এটি সম্পূর্ণরূপে স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়।

ইলিশ ক্রমে দু®প্রাপ্য মাছে পরিণত হতে থাকে। এমনকি ইলিশের মওসুমেও বাজারে ইলিশের তেমন দেখা মিলত না এবং সাধারণ আয়ের মানুষ ইলিশ কেনার কথা ভাবতেও পারত না। কিন্তু পরবর্তীতে সরকারি পর্যায়ে ইলিশ রক্ষায় বিভিন্ন ধরনের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করায় আবার ধীরে ধীরে বাজারে বাড়তে থাকে ইলিশের আমদানি। কয়েক বছর ধরে জেলেদের জালে এত পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ে যে, রাজধানীর প্রায় সব বাজার ছেয়ে যায় ইলিশে। পথে ঘাটে পর্যন্ত ফেরি করে বিক্রি করা হয় এখন ইলিশ মাছ। ইলিশের এত ছড়াছড়ির পরও এর দাম যে একেবারে কমে যায় তা নয়। যেমন সর্বশেষ বর্ষা মওসুমে রাজধানীতে সাড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রামের একটি ইলিশ মাছ বিক্রি হয়েছে ৪০০ থেকে সাড়ে ৪০০ টাকা। কেজি দর হিসাব করলে সাড়ে ৫০০ টাকা। ইলিশের যতই আমদানি বাড়–ক এর অতুলনীয় স্বাদ আর সবার কাছে কম বেশি প্রিয় হওয়ায় সব সময়ই এর চাহিদা থাকে তুঙ্গে। ফলে এর দাম কখনো আর আগের মতো পানির দর বলতে যা বোঝায় সে অবস্থায় নামে না। 

পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠী উপজেলার সোহাগদল গ্রামের সাইদুর রহমান বলেন, ১৯৮৬-৮৭ সালের কথা। আমার মনে আছে, আমি ১৫ টাকা দিয়ে একটি ইলিশ মাছ কিনেছি তখন। তখন ইলিশ মাছ এত পরিমাণ ধরা পড়ত যে, ইন্দেরহাট বাজারে মানুষের মাথা সমান উঁচু ইলিশের বিশাল স্তূপ হয়ে যেত। গ্রামের রাস্তায় ভ্যানে করে ইলিশ বিক্রি করতে দেখেছি। 

বর্তমানে রাজধানীতে বসবাসকারী ৪৭ বছর বয়সী সাইদুর রহমান বলেন, আমি সে সময় ১৫ টাকা দিয়ে যে ইলিশ মাছটি কিনেছি সে ধরনের ইলিশ মাছ আমি সর্বশেষ ইলিশের মওসুমে ৪০০ টাকা দিয়ে কিনেছি। এর ওজন ছিল প্রতি পিস সাড়ে ৭০০ গ্রাম। রাজধানীতে যখনই ইলিশ মাছ কিনি তখন আমার মনে পড়ে ছোটবেলার সেই সস্তায় ইলিশ মাছ কেনার স্মৃতি। 

কনজ্যুমারস অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ তথা ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী ১৯৯২ সালে মাঝারি আকারের এক কেজি রুই মাছের দাম ছিল ১৫২ টাকা আর মাঝারি আকারের এক কেজি ইলিশ মাছের দাম ছিল মাত্র ৫৫ টাকা। অবশ্য তখন বাজারে যে রুই মাছ পাওয়া যেত তা মূলত চাষবিহীন বা মুক্তপানির মাছ। চাষের মাছ বাজারে আসতে থাকায় কমতে থাকে রুই মাছের দাম। যেমন ১৯৯৯ সালেও এক কেজি রুই মাছের দাম ছিল ১৬০ টাকা। ২০০২ সালে তা কমে আসে ১১৩ টাকায়। অবশ্য ২০০৪ সাল থেকে অন্যান্য বিভিন্ন জিনিসপত্রের সাথে মাছের দামও বাড়তে থাকে। ২০০৬ সালে রুই মাছের কেজি বেড়ে হয় ১৯০ টাকা। কাতল মাছের দামও একই পর্যায়ে ছিল। 

২০১১ সালে ৫০০ গ্রাম ওজনের এক কেজি ইলিশ মাছের দাম হয় ৪৫০ টাকা। এক কেজি বা তার চেয়ে বেশি ওজনের ইলিশের কেজি হয় ৭০০ টাকা। অপর দিকে দেশী ছোট আকারের রুই মাছের কেজি ছিল তখন ১৮৫ টাকা, বড় সাইজের কেজি ৩২৩ টাকা আর বিদেশী রুইয়ের কেজি ছিল ২২০ টাকা। 

এক দশক ধরে বাজারে প্রচুর পরিমাণে আসতে থাকে ইলিশ। কোনো মওসুমে কম ধরা পড়ে, কোনো মওসুমে বেশি। ২০১৩ সালে ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি ছিল ৫৭৫ টাকা আর এক কেজি বা তার চেয়ে বেশি ওজনের ইলিশের কেজি এক হাজার ৪০ টাকা। ছোট আকারে দেশী রুই মাছের কেজি ছিল তখন ২৫৬ টাকা, বড় সাইজের ৩৪৫ টাকা। ২০১৬ সালে ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি ছিল ৫১৫ টাকা। এক কেজি ওজনের ইলিশ এক হাজার ৩৫ টাকা। আর দেশী ছোট রুই মাছের কেজি ৩১৫ টাকা, বড় সাইজের ৩২২ টাকা। আর গত দুই বছর ধরে রাজধানীর বাজারে ছিল ইলিশের ছড়াছড়ি। ফলে গত দেড় দশকের মধ্যে এত কম দামে ইলিশ মাছ বিক্রি হতে দেখা যায়নি। 

মাছে ভাতে বাঙালি বলে যে কথাটি চালু রয়েছে তার সত্যতা অনেকটা ম্লান হওয়ার পথে ছিল অনেক বছর ধরে। তবে রুই কাতল শিং কৈ তেলাপিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের চাষের মাছ বাজারে আসায় স্বল্প আয়ের মানুষ আবার ফিরতে পেরেছে মাছের বাজারে। কিন্তু মুক্ত পানির বা দেশী বলে প্রচলিত শিং কৈ মাগুর শোল আইড়সহ বিভিন্ন ধরনের মাছ এখন সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার সম্পূর্ণ বাইরে।


আরো সংবাদ



premium cement