২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ব্যাংকে বিশাল অঙ্কের খেলাপী ঋণে বিশ্বব্যাংকের উদ্বেগ

মঙ্গলবার আগারগাঁওস্থ সংস্থার ঢাকা দফতরে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান - নয়া দিগন্ত

চলতি অর্থবছরে (২০১৮-১৯) মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ বলে পূর্বাভাস দিয়েছে দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক। মেগা প্রকল্পে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীন চাহিদার কারণে এই প্রবৃদ্ধি হবে। কিন্তু ব্যবসায় পরিবেশে উন্নতি না হওয়ায় বেসরকারি বিনিয়োগে তেমন উন্নতি হয়নি। সংস্থাটি বলছে, সামষ্টিক অর্থনীতি চার ধরনের চাপের মূখে আছে। এগুলো হলো খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতির উলম্ফন, বিদেশি অর্থায়নের ঘাটতি, তারল্য সংকট এবং বাজেট ঘাটতির পরিমাণ বৃদ্ধি। কিন্তু ব্যাংকিং খাতে বিশাল অঙ্কের খেলাপী ঋণে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক এই দাতাসংস্থাটি। আর অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি টেকসই হচ্ছে না। কারণ বেসরকারী বিনিয়োগ সে অনুপাতে হচ্ছে না। অনেকটা স্থবিরই আছে। আমরা ঝুঁকিপূর্ণ অর্থায়নের দিকে ঝুঁকেছি।

আগারগাঁওস্থ সংস্থার ঢাকা দফতরে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আউটলুক প্রকাশ করে এই তথ্যগুলো জানানো হয়। অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মূখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। বক্তব্য রাখেন সংস্থার কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লূর রহমান, অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর এবং মিডিয়া প্রধান মেহরিন এ মাহবুব।

বিশ্বব্যাংক বলছে, এই প্রবৃদ্ধির সুফল কারা পাচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রবৃদ্ধিকে সংখ্যা দিয়ে না থেকে গুণগত মান দিয়ে দেখা উচিত। প্রবৃদ্ধির সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে কি না, তা দেখতে হবে। আর ঋণ পুন: তফসিলের কারণে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি বেড়ে যাবে। এতে চাপ বাড়বে বাজেটে। এজন্য আর্থিক খাতে সংস্কার আনতে হবে। আর এই পূস:তফসিলের সাথে রাজনৈতিক চাপও থাকে। তারা বলছে, গত অর্থবছরে খেলাপি ঋণের হার ১০ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। মোট খেলাপি ঋণের ৪৮ শতাংশই রাষ্ট্র মালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের। ৪০টি বেসরকারি ব্যাংকের আছে ৪৪ শতাংশ খেলাপি ঋণ।

বিশ্বব্যাংক মনে করে, বেসরকারি খাতে বিপুল বিনিয়োগ দরকার। বড় অবকাঠামোতে আরও সরকারি–-বেসরকারি বিনিয়োগ করতে হবে। প্রবাসী আয় ও রফতানি আয় বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিতে নতুন ভ্যাট আইনটি বাস্তবায়ন করা জরুরী। বিদ্যুতের লোড ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে কার্যকর করতে পারলে বছরে ১৬৫ কোটি ডলারের সমপরিমাণ তেলের দাম সাশ্রয় করা সম্ভব। রফতানির বাজারে সীমিত হওয়ায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক বলছে, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় দাতাদের অর্থায়নের উপর জোর দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। আর্থিক খাতে সুশাসন বিশেষ করে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি আরও উন্নতি করতে হবে।

বিশ্বব্যাংক বলছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ খাতে জোর দিতে হবে। এক হিসেবে বিশ্বব্যাংক জানায়, ২০১১-২০১৭ সাল পর্যন্ত ৪৭ শতাংশ মানুষ নতুন করে বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। এ সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে ৮০ শতাংশ। আগামী ২০৩০ সালের বিদ্যুতের চাহিদা মোকাবিলায় এখন থেকেই উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন করছে। কিন্তু এই উন্নয়ন ধরে রাখতে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। রফতানি ও রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি যেন কমে না যায় সেদিকে নজর রাখতে হবে। বিশ্বের ১০টি উদীয়মান দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এজন্য শিক্ষা, প্রযুক্তি, মানবসম্পদ উন্নয়নে মনোযোগী হতে হবে।

অর্থনীতিতে আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রভাব ফেলবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান বলেন, সব দেশই নির্বাচন প্রক্রিযার মধ্য দিয়ে যায়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি খুবই ভালো। কিন্তু এটি সংখ্যা দিয়ে বিবেচনা না করে, মান দিয়ে বিবেচনা করা উচিত।

মূল প্রবন্ধের আলোচনায় ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, প্রবৃদ্ধিতে দুটি বড় চিন্তার বিষয় আছে। একটি হলো, এই প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে কি না। অপরটি, প্রবৃদ্ধির সুবিধা সবাই পাচ্ছে কিনা। অর্থনীতিতে রূপান্তর আনা দরকার। কেননা বাংলাদেশে এখনো তিন কোটি ৯০ লাখ লোক দরিদ্র। তাদের মধ্যে এক কোটি ৯০ লাখ মানুষ অতি দরিদ্র। তিনি বলেন, আমরা ঝুঁকিপূর্ণ অর্থায়নের দিকে ঝুঁকেছি। পদ্মা সেতুতে ব্যয় অনেক বেড়েছে। নতুন করে যে রেল সংযোগের বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে তাও বিদেশী ঋণে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকারি হিসাবে ৮ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। কিন্তু এতে অনেক দুর্বলতা আছে। এই দুর্বলতা নিয়ে এই প্রবৃদ্ধি টেকসই করা অত্যন্ত কঠিন। কারণ বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। আগে রফতানি নির্ভর প্রবৃদ্ধি ছিল। এখন প্রবৃদ্ধি হচ্ছে অভ্যন্তরীন চাহিদা নির্ভর। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির বিতর্ককে সংখ্যার বাইরে নিয়ে যেতে হবে। বিতর্কের বিষয় হওয়া উচিত গুণগত মানসম্পন্ন প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কিনা। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হবে। এছাড়া অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রমে রাজনৈতিক সুশাসনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে হবে।

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আগামী দিনের জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন হলো সংস্কার বা প্রস্তুতিকে আরো শক্তিশালী করা। সঞ্চয়পত্রে সংস্কার আনতে হবে। শুধু সুদ হার একক অঙ্কে আনলে হবে না। ভর্তুকি সঠিকভাবে সঠিক খাতে যাচ্ছে কিনা সেটা মনিটরিং করতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যে ব্যয় ধরে অনুমোদন দেয়া হয়, সেটাকে শেষ করা যায় না। দফায় দফায় ব্যয় বাড়ানো হয়।


আরো সংবাদ



premium cement