২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

এক বছরেই বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধি ৮০ ভাগ

-

মূল্যের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা ক্রমেই কমে যাচ্ছে বাংলাদেশের রফতানিকারকদের। বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ অবকাঠামো সুবিধার অভাব আর চলমান অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রফতানি আয় অনেকখানি স্থবির হয়ে আছে। কিন্তু এর বিপরীতে আমদানি ব্যয় তো কমছেই না, বরং অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলছে। ফলে এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে বাণিজ্য ঘাটতির ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, বিদায়ী অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৮০ ভাগ বেড়ে গেছে, যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ বৃদ্ধি। এর প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, সমাপ্ত অর্থবছরের বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে দুই হাজার ২২০ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল এক হাজার ১৩৫ কোটি ডলার। অর্থনীতিবিদদের ধারণা, আমদানির নামে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে। আর এতেই বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতি। এটা অর্থনীতির জন্য মোটেও ভালো লক্ষণ নয়।

সাধারণ প্রবণতা অনুসারে, আমদানি ব্যয় বাড়লে রফতানি আয়ও বাড়ে। কারণ বিদেশ থেকে যেসব কাঁচামাল আমদানি করা হয় তার একটি অংশ প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে রফতানি হয়। অতীতে এমন হয়ে এলেও এবার এর ব্যতিক্রম লক্ষ করা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, বিদায়ী অর্থবছরে রফতানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। বিপরীতে আমদানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। ফলে এ সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে দুই হাজার ২২০ কোটি ডলার।

অপর দিকে আগের অর্থবছরে রফতানির প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১ দশমিক ১৬ শতাংশ, বিপরীতে আমদানির প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ শতাংশ। ফলে ওই বছরে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল এক হাজার ২৩৫ কোটি ডলার।

এ দিকে, রফতানি আয়ে কাঙ্ক্ষিত গতি না আসার পাশাপাশি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সেও প্রবৃদ্ধি খুব বেশি হয়নি। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। আবার আমদানিজনিত চাপে দেশের ভেতরে বেড়েছে ডলারের চাহিদা। ফলে চাহিদার তুলনায় ডলারের জোগান কমে গেছে। এ কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন ঘটছে। এক বছরের ব্যবধানে প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে প্রায় ছয় টাকা বা প্রায় সাড়ে পাঁচ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বাস্তবে আমদানি বাড়লে তা অর্থনীতিতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু আমদানির নামে যদি অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যায় তা দেশের জন্য হবে খুবই ক্ষতিকর। দেশের আমদানি-রফতানির ধারা বিশ্লেষণ করে অর্থনীতিবিদেরা আশঙ্কা করছেন যে, দেশের অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।

রফতানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় যেটুকু বেশি, তার পার্থক্যই বাণিজ্য ঘাটতি। আর চলতি হিসাবের মাধ্যমে দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝা যায়। আমদানি-রফতানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়-ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। এখানে উদ্বৃত্ত হলে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সমাপ্ত অর্থবছরে আমদানিতে রেকর্ড ব্যয় হয়েছে। পণ্যভেদে বেশি ব্যয় হয়েছে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও জ্বালানি তেল আমদানিতে। দৃশ্যমান বিনিয়োগ না বাড়লেও অস্বাভাবিক মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বৃদ্ধিকে স্বাভাবিক মনে করছেন না নীতিনির্ধারকেরা। সাম্প্রতিক সময়ে আমদানির নামে মুদ্রা পাচার হচ্ছে কি না সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তদারকি করার অনুরোধ করা হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, সমাপ্ত অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র স্থাপন হয়েছে প্রায় ২২ শতাংশ, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল সাড়ে ১০ শতাংশ। অপর দিকে জ্বালানি তেল আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩২ শতাংশ, যেখানে আগের বছরে একই সময়ে ছিল সাড়ে তিন শতাংশ। আর পণ্যের কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ১২ শতাংশ, যেখানে আগের অর্থবছরে ছিল সাড়ে তিন শতাংশ।

এ দিকে অস্বাভাবিক হারে আমদানি ব্যয় বাড়লেও রফতানি আয় কাক্সিক্ষত হারে বাড়েনি। যেমন, সমাপ্ত অর্থবছরে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস রেমিট্যান্স। কিন্তু গত অর্থবছরজুড়েই দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ নিম্নমুখী ধারায় ছিল। সম্প্রতি রেমিট্যান্স ইতিবাচক ধারায় ফিরলেও তা এখনো আশাব্যঞ্জক পর্যায়ে যায়নি।
রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহের সমন্বয়েও আমদানি ব্যয়ের ধারে কাছে যাচ্ছে না। ফলে চলতি হিসেবের ভারসাম্য ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, সমাপ্ত অর্থবছরে চলতি হিসেবের ভারসাম্য ঋণাত্মক হয়েছে ৯৭৮ কোটি ডলার, যা আগের বছরে একই সময়ে ছিল ১৩৩ কোটি ডলার।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ের রফতানি ও আমদানির ধারা দেখলে দেখা যায় এ দু’টির মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই সামঞ্জস্য হচ্ছে না। আমদানির ক্ষেত্রে মূলধনী যন্ত্রপাতির বাইরে পেট্রোলিয়াম, খাদ্যপণ্য প্রভৃতি অনেক বেশি আমদানি হচ্ছে। বিনিয়োগের গতিও বাড়ছে না। পাশাপাশি রফতানির ক্ষেত্রে যেভাবে মূল্যপতন হচ্ছে আমদানির ক্ষেত্রে সেভাবে হচ্ছে না। এতে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। আমদানি-রফতানির নামে অর্থ পাচার হচ্ছে কি না এমন প্রশ্নে তারা বলেন, এ ক্ষেত্রে রফতানির আন্ডার ইনভয়েসিং এবং আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং হচ্ছে কি না সে বিষয়টা খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে।


আরো সংবাদ



premium cement