২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

চামড়া নিয়ে নৈরাজ্যের নেপথ্যে

-

সাভারে চামড়া শিল্পনগরী স্থাপনের কাজ শুরু হয় ২০০৩ সালে। সেই থেকে প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে আটবার, ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ছয় গুণ। তিন বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের কাজ ২০০৫ সালে শেষ হওয়ার কথা। ১৬ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পের কাজ এখনো শেষ হয়নি। অথচ উৎপাদনের বিকল্প ব্যবস্থা না করেই র‌্যাব-পুলিশ দিয়ে জোর-জবরদস্তি করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো। প্রকাশ্যে কেউ মুখ খলতে সাহস না পেলেও শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা, অব্যবস্থাপনা ও হরিলুটই চামড়ার দর নিয়ে সৃষ্ট নৈরাজ্যের মূলে কাজ করেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, চামড়া শিল্পনগরীর অনুমোদিত বরাদ্দ ছিল ১৭৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। বাড়তে বাড়তে বরাদ্দ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকায়। ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। তিন বছরের প্রকল্প গড়িয়েছে ১৯ বছরে। সর্বশেষ আরো দুই বছর সময় বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত। কাগজে-কলমে এখন পর্যন্ত কাজ হয়েছে ৯০ শতাংশ। তবে বাস্তব অবস্থা অন্যরকম। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) চালু না হওয়ায় সব কিছুই ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে আছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে মারাত্মক ক্ষোভ কাজ করলেও সরকার নির্বিকার।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব অনুযায়ী চামড়া এখনো দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত। কিন্তু এ অবস্থা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। কারণ সম্ভাবনা যাই থাকুক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি থেকে আয় দিনদিন কমছে। চামড়াকে সরকার ২০১৭ সালে ‘বর্ষ-পণ্য’ ঘোষণা করে। কিন্তু ওই বছরের রফতানি পরিস্থিতি মোটেও ভালো নয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে রফতানি আয় হয়েছে ১০৮ কোটি ডলার, যা ল্যমাত্রার তুলনায় ২১ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় ১২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ কম। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ উৎস থেকে আয় হয়েছে ১২৩ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার।
চামড়া শিল্পের বর্তমান দুরবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, গত বছর যেসব কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল তারা এখনো উৎপাদনে যেতে পারেনি। আর আস্থার সঙ্কটের কারণে দীর্ঘদিনের বিদেশী ক্রেতারা অন্য দেশে চলে গেছেন। কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে যেসব ক্রেতা ফিরে গেছেন তাদের আনা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। চীন প্রচুর রফতানি আদেশ বাতিল করেছে। গত বছরের ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ চামড়া এখনো মজুদ। এ বছরও বিক্রির কোনো নিশ্চয়তা নেই। তিনি বলেন, চামড়া শিল্পনগরী চালুর উপযুক্ত হওয়ার অনেক আগেই আমাদের সেখানে ট্যানারি স্থানান্তরে বাধ্য করা হয়েছে। স্থানান্তরিত শিল্পনগরীতে পরিবেশসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা এখনো নিশ্চিত হয়নি। নগরীর এ অসম্পূর্ণতার কারণে বিদেশী ক্রেতা আকৃষ্ট হচ্ছে না।
অরাজকতার জন্য চামড়া শিল্পনগরী বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ বিসিককে দায়ী করে তিনি বলেন, জমি রেজিস্ট্রেশন করে দেয়ার কথা থাকলেও বিসিক গড়িমসি করছে। তারা সিইটিপির মূল্যের সাথে সমন্বয় করে জমির মূল্য নির্ধারণ করতে চাচ্ছে। শিল্প পার্কে যে অব্যবস্থাপনা হচ্ছে তার জন্য সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব বিসিকের বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ট্যানারি মালিকেরা বারবার বলেছেন, একটি পরিবেশবান্ধব শিল্প পার্ক দেয়া হোক। তাদের বিনিয়োগ কয়েক হাজার কোটি টাকা। নিজেদের টাকায় ব্যবসায়ীরা ট্যানারি স্থানান্তর করেছেন। অথচ চামড়া শিল্পনগরী পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ট্যানারিগুলো উৎপাদন করতে পারছে না।
তাড়াহুড়া করে ট্যানারি স্থানান্তরে শিল্পমালিকদের বাধ্য করার কথা স্বীকার করেছেন স্বয়ং তৎকালীন বিসিক চেয়ারম্যান মুশতাক হাসান মু. ইফতিখারও। এক সেমিনারে তিনি বলেন, চামড়া শিল্পনগরী হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তর করার ব্যাপারে আমি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিলাম, সাভারের নতুন চামড়া শিল্পনগরী এখনো প্রস্তুত নয়। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, অন্যরা বলছে কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে, আর আপনি বলছেন সম্পূর্ণ হয়নি। সরকারকে এমন ভুল বোঝানোর কারণে পুরোপুরি প্রস্তুতির আগেই প্রকল্পটি সাভারে স্থানান্তর হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
ট্যানারি ব্যবসায়ীদের দাবি, দীর্ঘদিন লোকসান গুনতে গুনতে এ খাতের ব্যবসায়ীরা দেনার দায়ে জর্জরিত। ব্যাংকঋণ আটকে আছে নানা শর্তের বেড়াজালে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে এক সময় ২২টি ট্যানারি থাকলেও তার ২১টিই একে একে বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে চালু আছে মাত্র একটি, যার প্রক্রিয়াকরণ সমতা ওই অঞ্চলে সংগৃহীত মোট চামড়ার ২০ শতাংশেরও কম। হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো পুরোপুরি বন্ধ। সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে বর্তমানে ট্যানারি আছে ১৫৫টি। এর মধ্যে উৎপাদনে সম ১১৫টি।
এ দিকে গত পাঁচ বছরের অধিকাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ হলেও অর্ধেকে নেমে এসেছে চামড়ার দাম। গরিব মিসকিনের অধিকার চামড়ার মূল্যের এই নিম্নমুখী প্রবণতা চলছে কয়েক বছর ধরেই। তারই ধারাবাহিকতায় ৯০ থেকে ১০০ টাকা বর্গফুট দরের চামড়ার মূল্য এবার সরকার এবং ট্যানারি মালিকেরা নির্ধারণ করেছেন মাত্র ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। বাস্তবে চামড়া বিক্রি হয়েছে ২০ থেকে ৩০ টাকায়। অন্য দিকে মোটা অঙ্ক বিনিয়োগ করে বেকায়দায় পড়েছেন হাজার হাজার মওসুমি চামড়া ব্যবসায়ী। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সরকারের সহযোগিতায় পারস্পরিক যোগসাজসের মাধ্যমে গরিব-মিকিনদের ঠকাতে একাট্টা হয়েছে স্বার্থবাদী সব পক্ষ।


আরো সংবাদ



premium cement