ব্যাংকের করপোরেট কর কমছে আড়াই শতাংশ
- আশরাফুল ইসলাম
- ০৭ জুন ২০১৮, ০৩:১৪
জাদুর কাঠি পেয়েছেন বেসকরারি খাতের ব্যাংক পরিচালকেরা। যত অসাধ্যই হোক না কেন জাদুর কাঠিটি স্পর্শ করলেই খুলে যাচ্ছে সাফল্যের দরজা। হ্যাঁ, বেসরকারি খাতের ব্যাংক পরিচালকেরা যা-ই চাচ্ছেন তাই হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত অর্থাৎ সিআরআর হার এক লাফেই এক শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয় সোনারগঁাঁও হোটেলে এক বৈঠকের মাধ্যমে। শুধু মাঝখানে রাখা হয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত রেপোর হারও কমিয়ে নেন তারা ওই বৈঠকে। এর আগে একই পরিবারের চারজন পরিচালক থাকার জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করিয়ে নেন পরিচালকেরা। আর দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে করপোরেট কর কমানোর যে দাবি বাস্তবায়ন হচ্ছে না, এবার একসাথেই তা আড়াই শতাংশ কমিয়ে নিচ্ছেন পরিচালকেরা। সব কিছু ঠিক থাকলে আজ বৃহস্পতিবার আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে এ ঘোষণা আসবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার স্বার্থে দেশের তৃতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এক পরিচালক বলেন, আমরা দেশ ও সরকারের নানাভাবে সেবা করছি। নিজেরা ব্যবসাবাণিজ্যের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছি। আবার ব্যাংকের মাধ্যমে শিল্পকারখানার অর্থায়ন করছি। সুতরাং নিয়মের সামান্য ব্যত্যয় হলেও আমাদের দাবি মেনে নিতে তেমন অসুবিধা নেই। এ কারণেই আমাদের দাবি অর্থমন্ত্রী একের পর এক বাস্তবায়ন করছেন। পাঁচ বছর ধরে করপোরেট কর কমানোর দাবি করে আসছেন; এত দিন বাস্তবায়ন হলো না; এবার এমনকি করলেন যে একের পর এক আপনাদের দাবি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে ওই পরিচালক বলেন, দেখেন সব সময় সবার মন এক থাকে না। আর এবার নির্বাচনী বছর। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই সরকার আমাদের যৌক্তিক সিদ্ধান্ত মেনে নিচ্ছে এটাই বাস্তবতা।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সব প্রতিষ্ঠানের করপোরেট করহার সর্বোচ্চ সাড়ে ৩৭ শতাংশ থাকলেও শুধু ব্যাংকের ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ রয়েছে। ব্যাংক ১০০ টাকা মুনাফা করলে ৪০ টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দিতে হয়। এমনকি ব্যাংকের মূলধনের ভিত্তি মজবুত রাখতে খেলাপি ঋণের বিপরীতে যে প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় সেই প্রভিশনের ওপরেও ৪০ শতাংশ কর দিতে হয় ব্যাংকগুলোকে। একই সাথে সুনির্দিষ্ট কিছু সিএসআর ছাড়া অন্য সব সিএসআরের ওপরও একই হারে কর পরিশোধ করতে হয়। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পরেও করহারের এ অসঙ্গিত দূর করতে দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে ব্যাংক পরিচালকেরা বাজেটের আগে ও পরে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু বরাবরই ব্যাংকের এ দাবি উপেক্ষা করা হচ্ছে।
এর কারণ হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, যে কয়েকটি খাত থেকে করপোরেট কর আদায় করা হয় তার মধ্যে ৭০ শতাংশ আসে শুধু ব্যাংক খাত থেকে। বাকি ৩০ শতাংশ আসে অন্যান্য খাত থেকে। সুতরাং ব্যাংকের করপোরেট কর কমিয়ে দিলে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যাঘাত ঘটবে। এ কারণেই এত দিন ব্যাংকের ওপর থেকে করপোরেট কর কমানো হয়নি; কিন্তু এবার সরাসরি অর্থমন্ত্রী করপোরেট করহার কমানোর বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দেয়ার কারণে নির্বাচনী বছরে ব্যাংকারদের সুবিধা দেয়া হচ্ছে। তবে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য রিভাইস বাজেটে এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনও হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ চাঙ্গা করতে ব্যাংক খাতের করহার ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৩৭ করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। কেননা বর্তমানে আয়ের প্রকৃতিভেদে ব্যাংক খাতসহ কোম্পানি বা করপোরেট করের ছয়টি স্তর রয়েছে। করপোরেট করের সর্বোচ্চ হার ৪৫ এবং সর্বনি¤œœ ২৫ শতাংশ। একক খাত হিসেবে ব্যাংক থেকে সবচেয়ে বেশি করপোরেট কর আদায় হয়। ব্যাংকগুলো বছরে যে পরিমাণ মুনাফা করে তা থেকে ৪০ শতাংশ হারে কর আদায় করে সরকার। জানা যায়, করপোরেট কর থেকে ১০০ টাকা আদায় হলে ৭০ টাকা আসে ব্যাংক খাত থেকে। অবশিষ্ট ৩০ টাকা অন্য সব কোম্পানি থেকে। বর্তমানে এনবিআরের অধীনে ৬০টি ব্যাংক নিবন্ধিত। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এসব ব্যাংক থেকে আদায় হয় সাত হাজার ৩০৪ কোটি টাকা।
ব্যাংক ছাড়া অন্য যেসব খাত থেকে করপোরেট কর আদায় করা হয় সেগুলো হলোÑ মোবাইল ও সিগারেট কোম্পানি ৪৫ শতাংশ, লিজিং ও মার্চেন্ট ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাড়ে ৩৭ শতাংশ, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয়Ñ এমন কোম্পানি ৩৫ শতাংশ এবং শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য ২৫ শতাংশ হারে করহার নির্ধারিত আছে। সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে শুধু ব্যাংক খাতের করপোরেট হার কমানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে। বাকি অন্য সব খাতের করহার আগের মতো অপরিবর্তিত থাকছে।
এর আগে বেসরকারি পরিচালকেরা অর্থমন্ত্রীকে নিয়ে সোনারগাঁও হোটেলে এক বৈঠক ডেকে আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার (সিআরআর) এক শতাংশ কমিয়ে নেয়। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা বাজারে ছাড়তে বাধ্য হয়। একই সময়ে ব্যাংকগুলো সঙ্কটে পড়লে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি নির্ধারিত হারে ব্যাংকগুলোকে অর্থের জোগান দেয়, যাকে ব্যাংকিং ভাষায় রেপো বলা হয়। অর্থমন্ত্রীর সাথে ওই বৈঠকে এ রেপোর হারও পৌনে ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬ শতাংশ করা হয়। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাপক চাপের মুখে পড়ে। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও ব্যাংক পরিচালকেরা। এর আগে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতের ৫০ শতাংশ বাগিয়ে নেন বেসরকারি খাতের পরিচালকেরা, যা আগে ছিল ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের ১০০ টাকা আমানত থাকলে এর ৭৫ ভাগ পেত সরকারি ব্যাংক, বাকি ২৫ ভাগ পেত বেসরকারি ব্যাংক। তারও আগে একই পরিবারের চারজন পরিচালক রাখার জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করিয়ে নেন ব্যাংক পরিচালকেরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, যেভাবে ব্যাংকের পরিচালকেরা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মতো একের পর এক তাদের ব্যক্তিস্বার্থের জন্য দাবি আদায় করে নিচ্ছেন তাতে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন ক্ষমতাও ভেঙে পড়বে। ব্যাংকগুলোর অপকর্ম ঠেকানোর মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা থাকবে না।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা