২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

খেলাপি ঋণ : ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা

টাকা - ছবি : সংগৃহীত

এক শ্রেণীর প্রভাবশালী ব্যক্তি ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে আর শোধ করছেন না। ঋণ দুর্বৃত্তদের অপকর্মের খেসারত গুনতে হচ্ছে গোটা জাতিকে। বলা চলে দেশের ব্যাংকিং খাতে ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপির সংখ্যা বাড়ছে, যার জন্য দায়ী কিছু বড় ঋণখেলাপি। তারা ব্যাংক থেকে নানা কৌশলে ঋণ নিচ্ছেন। কিন্তু আর ফেরত দিচ্ছেন না। আর এ বড় ঋণখেলাপির কারণে সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পাহাড় জমে গেছে। গত এক দশকে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ চার গুণ বেড়েছে। আর মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ১৪ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। তবে, অবলোপন হওয়া প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ যোগ করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হবে প্রায় ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা।


বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ও বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এতে সার্বিক ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ফের দুই অঙ্কের ঘর অতিক্রম করেছে। গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ৭৮ শতাংশ, যা গত ডিসেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। একই সাথে মার্চ পর্যন্ত মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে আদায় অযোগ্য কুঋণ বেড়ে হয়েছে ৭৩ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ঘটনায় ব্যবসায় লোকসানের কারণে অনেক ঋণগ্রহীতা খেলাপি হতেই পারেন। এ ক্ষেত্রে খেলাপি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বন্ধক রাখা জমি বা সম্পদ নিলাম করে ঋণের টাকা আদায় করে ব্যাংক। কিন্তু এখন অনেক ঋণগ্রহীতাই ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হচ্ছেন। তারা বন্ধকী সম্পত্তি নিলাম করে টাকা আদায়েও বাধা দিচ্ছেন। ফলে বিপাকে পড়েছে সরকারি- বেসরকারি বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক। আর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। বড় বড় কয়েকটি ঋণগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মসংস্থানের বিষয়টি মাথায় রেখে বড় অঙ্কের কিছু ঋণ পুনর্গঠন করার সুযোগ দেয়া হলেও তাতে আশানুরূপ ফল দেয়নি। এই ঋণও আবার খেলাপি হয়ে পড়েছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংক অর্থঋণ আদালতে মামলা করেও সুফল পাচ্ছে না। কারণ ঋণগ্রহীতারা প্রভাবশালী হওয়ায় তারা আইনজীবীদের মাধ্যমে মামলা পরিচালনা করান। পরিস্থিতির সুযোগ নিতে যেন অনেকটা নিয়ত করেই ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে খেলাপি হচ্ছেন প্রভাবশালীরা। এতে ব্যাংকব্যবস্থা ধসে পড়ছে। জনগণের করের টাকায় প্রতি বছর ব্যাংকগুলোর মূলধন পুনভরণ করে বাঁচিয়ে রাখতে হচ্ছে।

জানা যায়, গত বছরের শেষ দিকে বিপুল অঙ্কের ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত ও আদায় জোরদায় করায় খেলাপি ঋণ এক অঙ্কের ঘরে নেমে আসে। কিন্তু চলতি বছরে খেলাপি ঋণ আবার লাগামহীনভাবে বাড়তে শুরু করেছে। এর কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলো তাদের অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাই সেখানে ভালো অবস্থান দেখাতেই বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে থাকে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে অন্যতম হলো খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল বা নবায়ন। আর বছরের শেষ সময়ে এসে এই সুবিধা দেয়া-নেয়ার প্রবণতাও বাড়ে। এ ছাড়া শেষ সময়ে ঋণ আদায় কার্যক্রম জোরদার করা হয়। কিন্তু বছরের শুরুতেই ঋণ পুনঃতফসিল যেমন কম হয়, তেমনি আদায় কার্যত্রমেও সে রকম গতি থাকে না। 
সূত্র বলছে, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের বিশেষ সুবিধা দিতে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনে (নিয়মিত) বিশেষ ছাড় দেয়া হয়। ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই আড়াই বছরেই এ সুযোগ নেন দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় বড় শিল্প গ্রুপ। এর আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি সাপেক্ষে প্রায় ৪৯ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত করা হয়েছে। এর বাইরে বিদ্যমান নীতিমালার আওতায় ব্যাংকগুলো নিজেরা আরো ৬৪ হাজার ৮৬২ কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত করেছে। সব মিলে ওই সময় পর্যন্ত মোট ১ লাখ ১৩ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকার ঋণ বিশেষ সুবিধায় নিয়মিত করা হয়েছে। পরে ব্যাংক খাতে পাঁচ শ’ কোটি টাকার বেশি ঋণ রয়েছে এ রকম ১১টি ব্যবসায়ী গ্রুপকে ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত এসব ঋণগ্রাহক যথাসময়ে ফেরত দিচ্ছেন না। ফলে তা আবারো খেলাপি হতে শুরু করেছে। 

খেলাপি ঋণ এ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা, রাজনৈতিক বিবেচনায় বড় ঋণখেলাপিদের আইনের আওতায় না আনা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ সুবিধায় যেসব ব্যবসায়ী ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই খেলাপি ঋণ নবায়ন করেছিলেন ওই সব ঋণ আবার খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে।

কারণ এ সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের কোনো উন্নতি হয়নি। যেসব ব্যবসায়ী খেলাপিতে পরিণত হয়েছিলেন ওই সব ব্যবসায়ী ক্রমন্বয়ে লোকসানের ঘানি টানতে টানতে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। এর ফলে তারা নবায়ন হওয়া খেলাপি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক বড় বড় ব্যবসায়ীকে ঋণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ওই সব ব্যবসায়ী ঋণ পরিশোধ করছেন না। আবার রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা ওই সব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যাংক মামলা দায়ের করেও তেমন কোনো সুবিধা করতে পারছে না। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার এটাও একটি কারণ বলে সাবেক এ গভর্নর মনে করেন। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থাকেও খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল তদারকির কারণে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, বেসিক ব্যাংকসহ বড় বড় ঋণকেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এসব ঋণ আর পরিশোধ না করায় তা খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। সব মিলে দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। আর খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলো তার আয় থেকে বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোর আন্তরিক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে ৮ লাখ ২২ হাজার ১৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বা ১০ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এর তিন মাস আগে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। 

প্রাপ্ত তথ্য মতে, গত তিন মাসে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে। এর পরিমাণ ৭ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। এর পরেই রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলো। এ খাতের ছয় ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬ হাজার ৩৫৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। বিদেশী নয় ব্যাংকের বেড়েছে ৩৪ কোটি টাকা। তবে গত তিন মাসে বিশেষায়িত দুই ব্যাংকে নতুন করে খেলাপি ঋণ বাড়েনি। 

প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের ১ লাখ ৪৬ হাজার ৪১৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা বিতরণের বিপরীতে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৪৩ হাজার ৬৮৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা; যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ২৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ। তিন মাস আগে এই ছয়টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৩৭ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা বা ২৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। 

২০১৮ সালের মার্চ শেষে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ২১ হাজার ২৯০ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এর বিপরীতে খেলাপি হয়েছে ৩৭ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা; যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ৬ শতাংশ। তিন মাস আগে ডিসেম্বর পর্যন্ত এ খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ২৯ হাজার ৩৯৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা। 

মার্চ শেষে বিদেশী খাতের ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ৩১ হাজার ২২৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকার ঋণের বিপরীতে খেলাপি হয়েছে ২ হাজার ১৮৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা; যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ০১ শতাংশ। তিন মাস আগে বিদেশী ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ২ হাজার ১৫৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। 
অন্য দিকে, এ সময়ে সরকারি মালিকানার দুই বিশেষায়িত ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ১৯৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এর বিপরীতে খেলাপি হয়েছে ৫ হাজার ৪২৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা; যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ২৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ। তিন মাস আগেও এই ব্যাংক দু’টির একই পরিমাণ খেলাপি ঋণ ছিল। 

ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপি : বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দেশের ব্যাংকিং খাতে অবলোপনসহ মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বেশির ভাগই আদায় অযোগ্য বা কুঋণে পরিণত হয়েছে। এসব ঋণ আদায়ে মামলাও করা হয়েছে। কিন্তু অর্থঋণ আদালতে পর্যাপ্ত সংখ্যক বেঞ্চ এবং বিচারক না থাকায় মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে না। আবার সুপ্রিম কোর্ট অব বাংলাদেশের হাইকোর্ট ডিভিশনে অর্থঋণ আদালতের জন্য পৃথক কোনো বেঞ্চ নেই। সব মিলে খেলাপি ঋণ আদায় হচ্ছে না। খেলাপি ঋণ আদায় না হওয়ায় ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের সক্ষমতা কমে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবলোপনকৃত ঋণের ক্ষেত্রে কিছু কিছু খেলাপি গ্রাহক আংশিক ঋণ পরিশোধ করে অবশিষ্ট অংশ বিশেষ করে সুদ ও আসলের একটি অংশ মওকুফের আবেদন করছে। তবে আসল মওকুফের সুযোগ না থাকায় এ ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে বন্ধকীকৃত সম্পত্তি বিক্রয় বা ব্যাংকের অনুকূলে মিউটেশন করা যাচ্ছে না। সব মিলেই শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।

জানা গেছে, একজন ঋণখেলাপি অন্য কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারেন না। এমনকি জাতীয় কোনো নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করতে পারেন না। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খেলাপি ঋণ আদায়ের সবচেয়ে বড় জটিলতা দেখা দিয়েছে আইনগত জটিলতা। শ্রেণীকৃত ঋণ আদায়ে আইনি জটিলতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। খেলাপি গ্রাহকেরা ঋণ পরিশোধ না করার জন্য বিভিন্ন আইনি ফাঁকফোকর বের করছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে খেলাপি গ্রাহকরা শ্রেণীকরণ হতে বেরিয়ে আসার জন্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করে শ্রেণীকরণের ওপর স্থাগিতাদেশ নিচ্ছেন। এ সুবাদে তারা অন্য ব্যাংক থেকে ঋণসুবিধা নিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে আইনগত বাধা না থাকলেও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো প্রকৃতপক্ষে একজন ঋণখেলাপিকেই গ্রাহক হিসেবে গ্রহণ করছে। ওই গ্রাহক ফের খেলাপি হয়ে আবার আদালতে মামলা দায়ে করছেন। এভাবে ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে তারা আইনি প্রত্রিয়া গ্রহণ করছেন। এতে ব্যাংকগুলোর জন্য অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে দেখা দিচ্ছে। একই সাথে খেলাপি ঋণ আদায় কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। 

এক দশকে চার গুণ হয়েছে খেলাপি ঋণ : বাংলাদেশে ব্যাংক লুটপাট ও খেলাপির ভয়ঙ্কর এ চিত্র এক দশক আগেও চোখে পড়েনি। তখন ব্যবসা করতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ প্রকৃত অর্থেই লোকসান করে খেলাপি হতেন। খুব কমসংখ্যক ব্যবসায়ীই ঋণ নিয়ে ইচ্ছা করে খেলাপি হতেন। খেলাপি ঋণ ‘মহামারী আকার’ ধারণ করেছে মূলত ২০১২ সাল থেকে।

২০০৭ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল ২২ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা, যা ওই সময় পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের ১৩.২৩ শতাংশ ছিল। ২০০৮ সাল শেষে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমে ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকায় নামে, খেলাপির হার দাঁড়ায় ১০.৭৯ শতাংশ। এই ঋণ ও এর হার পরের বছরগুলোতে ছিল এ রকম : ২০০৯ সাল শেষে খেলাপি ঋণ ২২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯.২১ শতাংশ। ২০১০ সালে ২২ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা এবং মোট ঋণের ৭.২৭ শতাংশ, ২০১১ সালে ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা (৬.১২ শতাংশ), ২০১২ সালে ৪২ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা (১০.০৩ শতাংশ), ২০১৩ সালে ৪০ হাজার ৫৮৩ টাকা (৮.৯৩ শতাংশ), ২০১৪ সালে ৫০ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা (৯.৬৩ শতাংশ), ২০১৫ সালে ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা (৮.৭৯ শতাংশ) এবং ২০১৬ সালে ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা (৯.২৩ শতাংশ)। আর ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের শেষে ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মার্চ শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১০ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এটি যোগ করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া অনেক ঋণখেলাপি আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে নিজেদের খেলাপি হিসেবে দেখানোর হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন বলেও জানা যায়। এতেও বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপি হয়েও খেলাপির হিসাবে যোগ হচ্ছে না। এই ঋণগুলো যোগ হলে খেলাপি ঋণের চিত্র আরো ভয়াবহ হবে বলে মনে করেন ব্যাংক খাত বিশেষজ্ঞরা।


আরো সংবাদ



premium cement