২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মালয়েশিয়া দুবাইসহ একের পর এক শ্রমবাজার বন্ধ

মালয়েশিয়া দুবাইসহ একের পর এক শ্রমবাজার বন্ধ - ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাত। এ বাজারটি সাত বছর ধরেই বন্ধ হয়ে আছে। অনেক চেষ্টা তদবির করার পরও আজ পর্যন্ত দেশটিতে শ্রমিক (পুরুষ) পাঠানো শুরু করতে পারেনি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। শুধু সংযুক্ত আরব আমিরাতই নয়, একইভাবে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার মালয়েশিয়া ও বাহরাইনের মার্কেটও বন্ধ হয়ে রয়েছে। মালদ্বীপ সরকার তার দেশে এক বছরের জন্য বাংলাদেশ থেকে কর্মী না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নতুন করে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ ধনী দেশ কাতার সরকারও কিছু দিন ধরে বাংলাদেশী কর্মীদের নামে ভিসা ইস্যু করছে না। যেকোনো সময় কাতারের শ্রমবাজারটিও হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

একের পর এক শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে জনশক্তি রফতানি সেক্টরে। তবে নতুন করে জাপানে বাংলাদেশী শ্রমিক যাওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় কিছুটা চাঙ্গাভাব দেখা দিয়েছে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মধ্যে। তবে যেভাবে একেকটি দেশের শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণে নিতে সিন্ডিকেট গড়ে উঠছে, তাতে জনশক্তি রফতানি ব্যবসায় সম্পৃক্তরা রীতিমতো শঙ্কিত।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক গেছেন চার লাখ ১৭ হাজার ৮৪ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪৪ হাজার ৭১৩ জন শ্রমিক গেছেন সৌদি আরবে। এরপরের অবস্থানে আছে জর্ডান। দেশটিতে গেছেন ১২ হাজার ১২৩ জন। ওমানে গেছেন সাত হাজার ৯২৭ জন। আর কাতারে এ সময়ের মধ্যে গেছেন দুই হাজার ৫২৩ জন। তবে আট মাসে বিদেশে যত জনশক্তি রফতানি হয়েছে, তার মধ্যে ৭১ হাজার ৯৪৫ জন নারী শ্রমিক পাড়ি জমিয়েছেন। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ৫৯ হাজার ৩৭ জন শ্রমিক বিদেশে গেছেন। মার্চ মাস পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত থাকে। এপ্রিল ও মে মাসে বেড়ে আগের অবস্থায় ফিরে আসে। কিন্তু জুন মাসে সেটি আবার কমে যায়। জুলাই মাসে বেড়ে ৫২ হাজার ৫৮ জনে দাঁড়ায়। কিন্তু এক মাসের ব্যবধানে অর্থাৎ আগস্ট মাসে সেটি কমে ৩২ হাজার ২৭২ জনে এসে ঠেকে। মানে জুলাই থেকে আগস্ট- এক মাসের ব্যবধানে ২০ হাজার শ্রমিক বিদেশে কম রফতানি হয়। অথচ দুই বছর আগেও বাংলাদেশ থেকে এক বছরে সর্বোচ্চ ১০ লাখ শ্রমিক বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিল। আর সেই ধারা থেকে বেরিয়ে এখন শ্রমিক যাওয়ার হার কমতে কমতে জনশক্তি রফতানি গড়ে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে পরিসংখ্যানে দেখা যায়।

এ প্রসঙ্গে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর বহির্গমন শাখার পরিচালক মো: মুজিবর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি অসুস্থ বলে জানান। বিএমইটির পরিসংখ্যানে সেপ্টেম্বর মাসে কত শ্রমিক গেছেন সেটি জানা সম্ভব হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, বহির্গমন শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণেও বৈধপথে শ্রমিক যাওয়ার হার কমছে।

জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার সিনিয়র সদস্য এবং অভিবাসন বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত এক ব্যবসায়ী নাম না প্রকাশের শর্তে নয়া দিগন্তকে বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজারগুলো বন্ধ এবং সাম্প্রতিক সময়ে শ্রমিক যাওয়ার হার কমার অন্যতম কারণ হিসেবে সিন্ডিকেশনের অতি উৎসাহীকরণকেই দায়ী করেন। তিনি বলেন, মালয়েশিয়া সরকার আগেই ঘোষণা দিয়েছিল, তারা বাংলাদেশ থেকে তিন বছরে পর্যায়ক্রমে ১৫ লাখ শ্রমিক নেবে। কিন্তু সেখানে দুই বছরে গেছে মাত্র পৌনে তিন লাখ শ্রমিক। এর পরই সিন্ডিকেশনের কারণে দেশটির সরকার এসপিএএ সিস্টেম বাতিল করে দেয়; যার কারণে বাকি শ্রমিকেরা আর যেতে পারেননি শুধু সিন্ডিকেশনের ভেতরে তৈরি হওয়া একাধিক গ্রুপ তৈরি হওয়ার কারণে। এই নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে এমন প্রতিযোগিতাও অন্যতম কারণ।

এটি শুধু মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে নয়; দুবাই, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর ক্ষেত্রেও একইভাবে সিন্ডিকেটের থাবা পড়েছে। এর মধ্যে তারা কেউ মেডিক্যাল সিন্ডিকেট করছে, কেউ ভিসা সিন্ডিকেট করছে। ওই অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ক্ষোভ প্রকাশ করে আরো বলেন, সৌদি আরবের লেবার ল অনুযায়ী বিদেশী কর্মী নিয়োগে কর্মীর কাছ থেকে কোনো ধরনের অভিবাসন ব্যয় নেয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু তার পরও কি দেশটিতে কেউ বিনা পয়সায় যেতে পারছে?
জনশক্তি রফতানিকারক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশে শ্রমবাজার বন্ধ ও শ্রমিক যাওয়ার গতি কমে যাওয়ার আরো কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে রিক্রুটিং এজেন্সির সাথে মন্ত্রণালয় তথা সরকারের মধ্যে আস্থার সঙ্কট তৈরি হওয়া। এই দূরত্ব না কমানো পর্যন্ত শ্রমবাজারে কোনো দিনও চাঙ্গাভাব ফিরে আসবে না। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে একাধিক রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক নয়া দিগন্তকে বলেছেন, সরকারের মাইগ্রেশন পলিসি (আইনকানুন) কন্ট্রোল করার প্রচেষ্টা বেশি; যার কারণে শ্রমবাজার দৃশ্যমান হচ্ছে না।

দূতাবাস ও হাইকমিশন সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২০১২ সাল থেকেই সংযুক্ত আরব আমিরাতের বৃহৎ শ্রমবাজারটি বন্ধ হয়ে আছে। দেশটির সরকার বাংলাদেশ থেকে শুধু নারী শ্রমিকের জন্য ভিসা দিলেও পুরুষ শ্রমিক নিতে অদ্যাবধি গড়িমসি করছে। কী কারণে তারা গড়িমসি করছে, তা পরিষ্কার করেও বলছে না। তবে এ নিয়ে দেশটিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা দফায় দফায় বৈঠক করেও এর কোনো কিনারা করতে পারেননি। এমনকি ঢাকা থেকে একাধিকবার প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী দেশটি সফর করে ইউএই সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে অনুরোধ জানানোর পরও সাড়া মিলছে না।

একইভাবে ২০১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে মালয়েশিয়া সরকার এসপিএএ সিস্টেম বন্ধ করে রেখেছে। এই মার্কেটটিও খুলবে খুলবে করে গতকাল পর্যন্ত খোলেনি। এই শ্রমবাজার আদৌ খুলবে কি না তা নিয়ে সরকার তথা ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছে নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
একইভাবে চুরি, ছিনতাই, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগে আগেই বাহরাইন সরকার বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সম্প্রতি মালদ্বীপ সরকার আগামী এক বছর তার দেশে বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য ভিসা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাতারে দুই নেপালি খুনের ঘটনায় বাংলাদেশীদের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠার পর থেকেই এর প্রভাব পড়েছে শ্রমবাজারে। দুই সপ্তাহ ধরেই দেশটির লেবার মিনিস্ট্রি বাংলাদেশী শ্রমিকদের নামে কোনো ভিসাই ইস্যু করছে না।
এসব বিষয়ে গত মঙ্গলবার রাতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদের বক্তব্য নেয়ার জন্য চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। পরে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে নতুন দায়িত্ব পাওয়া অভিজ্ঞ কর্মকর্তা মো: সেলিম রেজার সাথে যোগাযোগ করা হলে তারও মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।
এর আগে জনশক্তি রফতানিকারক একজন ব্যবসায়ী নয়া দিগন্তকে বলেন, আমি যতটুকু জানতে পেরেছি, সৌদি সরকার আগামী বছর থেকে বাংলাদেশীদের জন্য ভিসা না দেয়ার একটি সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। এ বিষয়টি যদি সঠিক হয়ে থাকে তা হলে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে বড় ধরনের একটি ধাক্কা আসতে পারে। এখন থেকেই সরকারকে এ নিয়ে হিসাব করে এগোনোর পরামর্শ দেন। একই সাথে তিনি বিভিন্ন দেশে ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ শ্রমিক তৈরি করে পাঠানোর জন্য পরামর্শ দেন। নতুবা শ্রমবাজারে আরো অধঃপতন হতে থাকবে বলে তিনি তার মতামত ব্যক্ত করেন।

মঙ্গলবার রাতে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান নয়া দিগন্তকে বলেন, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালদ্বীপসহ যেসব শ্রমবাজার এখনো বন্ধ আছে সেগুলো খোলার ব্যাপারে আমাদের মন্ত্রী আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে মালয়েশিয়ার মার্কেট নিয়ে বেশ কিছু অগ্রগতি রয়েছে। মন্ত্রী নিজেই সেটি তদারকি করছেন। আশা করছি এই মাসের শেষ নাগাদ অথবা আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে মালয়েশিয়াতে সেই প্রটোকলে সই হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আর দুবাই মার্কেট বন্ধ থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ মার্কেটটি নিয়ে মন্ত্রী কয়েকবার দেশটি ভিজিট করেছেন। আগামী দু-তিন মাসের মধ্যে মার্কেটটি খোলার একটা সম্ভাবনা আছে। সে ব্যাপারে মন্ত্রণালয় সারাক্ষণ তদারকি করছে।

মালদ্বীপ প্রসঙ্গে বায়রা মহাসচিব বলেন, অদক্ষ ছাড়া বাকি সব সেক্টরে শ্রমিক যাওয়া চালু আছে। বিদেশী কোটা নিরূপণের জন্য তারা আপাতত শ্রমিক নেয়া স্থগিত রেখেছে। যাচাই-বাছাই শেষে তারা আবার শ্রমিক নেয়া শুরু করবে। কর্মী যাওয়ার হার কমে যাওয়ার কারণ বলতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাদের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কাছে সৌদি আরবের যে ভিসাগুলো আছে সেগুলো তারা নানাবিধ কারণে প্রসেস করতে পারেনি। এর মধ্যে দুই শতাধিক লাইসেন্সের কার্যক্রম দূতাবাসে স্থগিত হয়ে আছে। এগুলো প্রসেসিং করা গেলে তখন দেখা যাবে এই মাসে অথবা আগামী মাসেই কর্মী যাওয়ার হার বেড়ে গেছে।


আরো সংবাদ



premium cement