২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

তিস্তা চুক্তি না হলেও বন্দর সুবিধা পেতে যাচ্ছে ভারত

তিস্তা চুক্তি না হলেও বন্দর সুবিধা পেতে যাচ্ছে ভারত - ছবি : সংগৃহীত

তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হলেও চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ পেতে যাচ্ছে ভারত। অথচ এর আগে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঢাকা সফরের সময় তিস্তার পানি বণ্টনে দিল্লি অপারগতা প্রকাশ করায় বন্দর দু’টি ভারতকে ব্যবহারের সম্মতিপত্র সই থেকে বিরত ছিল ঢাকা। অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফরের সময়ে দুই সরকারের চলতি মেয়াদেই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সইয়ের প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দুই সরকারের মেয়াদের শেষ পর্যায়ে এসে সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে থাকা ইস্যু তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিটি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গ্যাঁড়াকলে পড়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির অনমনীয় মনোভাবের কারণে বছরের পর বছর ধরে অনিষ্পন্ন এই ইস্যুটি ঝুলে রয়েছে। এ কারণে তিস্তার ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষকে খেসারত দিতে হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে এই দুর্ভোগ লাঘব হবেÑ এমন আশাও ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে।

ভারত তার ভূমিবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর জন্য বাংলাদেশের কাছ থেকে দীর্ঘ দিন ধরে ট্রানজিট চেয়ে আসছে। তিস্তার পানি বণ্টনে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য ট্রানজিটকে ট্রাম্প কার্ড হিসেবে হাতে রেখেছিল বাংলাদেশ। ভারত বারবার বাংলাদেশকে বোঝাতে চেষ্টা করছে দুই দেশের সম্পর্ক কেবলমাত্র একটি ইস্যুবন্দী হয়ে থাকতে পারে না। প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে উচ্চপর্যায়ে রয়েছে বলে দাবি করে ভারত ও বাংলাদেশ। এ জন্য তিস্তা ইস্যুতে নমনীয় হয়ে বাংলাদেশকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অন্যান্য দিক নিয়ে অগ্রসর হতে হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারে ভারতের সাথে চূড়ান্ত চুক্তি সই ও বিধি-বিধান (এসওপি) প্রণয়নের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। মন্ত্রিসভায় পাস হওয়া খসড়া চুক্তিটি চলতি মাসেই দিল্লিতে নৌপরিবহন সচিব পর্যায়ে সই হওয়ার কথা রয়েছে। এর পরপরই এসওপি চূড়ান্ত করা হবে। মতামতের জন্য খসড়া এসওপি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) পাঠানো হয়েছে।

এ ব্যাপারে নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেছেন, দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে কানেক্টিভিটি বাড়–ক এটা আমরা চাই। তবে এই কানেক্টিভিটি সর্বক্ষেত্রে পারষ্পরিকতার ভিত্তিতে বাড়লে তা টেকসই সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি করে। ভারতকে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, তা পূরণের দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ভারতও তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলো রক্ষায় একইভাবে উদ্যোগী হবে এবং তা বাস্তবায়ন করবে-এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

২০১৫ সালের জুনে নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফরকালে ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেয়ার জন্য সমঝোতা স্মারকসহ (এমওইউ) রেকর্ডসংখ্যক চুক্তি সই হয়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর মোদির বাংলাদেশ সফরকে অত্যন্ত ফলপ্রসূ আখ্যায়িত করে ভারতীয় মিডিয়া বলেছিল, ভারত যা চেয়েছিল, সবই পেয়েছে। ২০১৭ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফরে যান। এ সময় প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, ডিফেন্স লাইন অব ক্রেডিট এবং বিভিন্ন প্রতিরক্ষা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মধ্যে এমওইউসহ ২২টি চুক্তি সই হয়। এ সময় নরেদ্্র মোদির সাথে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের জানুয়ারিতে দুই দেশের সম্মতি অনুযায়ী তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি করতে নয়াদিল্লির প্রতি অনুরোধ জানান। জবাবে মোদি বলেন, এ ব্যাপারে দ্রুত চুক্তি সম্পাদনে তার সরকার ভারতে সংশ্লিষ্ট সবার সাথে কাজ করছে। দুই প্রধানমন্ত্রী ফেনী, মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার নদীর মতো অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনসংক্রান্ত বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন।

দিল্লি সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক করেন মমতা ব্যানার্জি। মমতা জানান, তিস্তার ওপর পশ্চিমবঙ্গ পুরোপুরি নির্ভরশীল। বাংলাদেশের সাথে সীমান্তসংলগ্ন তোরসার মতো অন্যান্য নদীর পানি বণ্টন হতে পারে। তোরসা বাংলাদেশের পদ্মা নদীর সাথে সংযুক্ত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর মমতার উপস্থিতিতে মোদি ঘোষণা দেন, দুই দেশের বর্তমান সরকারের মেয়াদেই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হবে।
সইয়ের জন্য চূড়ান্ত করা তিস্তার পানি বণ্টনের ১৫ বছর মেয়াদি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তিতে ভারতের জন্য ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ, বাংলাদেশের জন্য ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং বাকি ২০ শতাংশ পানি নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য রাখা হয়েছিল। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে মনমোহন সিং ঢাকা সফরের সময় এই চুক্তি সই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসায় এই আয়োজন ব্যর্থ হয়। পাল্টা হিসেবে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ভারতকে ব্যবহার করতে দেয়ার সম্মতিপত্র সই করা থেকে বিরত থাকে বাংলাদেশ।
রংপুর অঞ্চলে তিস্তার ঐতিহাসিক প্রবাহ ছিল পাঁচ হাজার কিউসেক পানি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তা ৫০০ কিউসেক বা তারও কমে নেমে আসে। তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল কৃষক ও মৎসজীবীরা এতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

তিস্তার পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ার জন্য মমতা ব্যানার্জি উজানের সিকিম প্রদেশকে দায়ী করছেন। তিস্তার ওপর নির্ভর করে সিকিম বেশকিছু জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছে। এতে নদীর স্বাভাবিক গতি প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে বলে দাবি করেছেন মমতা। তবে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবা ব্যারাজ থেকে বিপুল পানি কৃষি কাজের জন্য প্রত্যাহার করা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের জন্য স্পর্শকাতর ইস্যু হওয়ায় বাংলাদেশের সাথে তিস্তার পানি ভাগাভাগির চুক্তিতে যেতে চাইছেন না মমতা।

ট্রানজিট পণ্যে অগ্রাধিকার : খসড়া চুক্তিতে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুবিধা থাকলে ট্রানজিট পণ্যকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলা হয়েছে। বন্দর ব্যবহারের জন্য বিদ্যমান হারে চার্জ পরিশোধ করবে ভারত। তবে কোনো শুল্ক আরোপ করা হবে না। জেনারেল অ্যাগ্রিমেন্ট অন ট্রাফিক অ্যান্ড ট্রেড (গ্যাট) এবং বাংলাদেশের আইন ও বিধি মেনে ট্রানজিট পণ্য চলাচল করবে। পণ্য চলাচলের জন্য চারটি রুট নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো হলো আখাউড়া-আগরতলা, তামাবিল-ডাউকি, শেওলা-সুতারকান্দি এবং সীমান্তপুর-বিবিরবাজার। ট্রানজিট পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের ট্রাক ও নৌযান ব্যবহার করা হবে। 

বর্তমানে কলকাতা থেকে আসাম ঘুরে ত্রিপুরার আগরতলা পৌঁছাতে এক হাজার ৫৬৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে পর্বতসঙ্কুল দুর্গম সড়ক। আর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ত্রিপুরার আগরতলার দূরত্ব (ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ব্যবহার করে) ২১৬ কিলোমিটার। তবে রামগড়-সাব্রুম রুট ব্যবহার করলে এই দূরত্ব মাত্র ৭২ কিলোমিটারে নেমে আসবে। নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশের রামগড়ের সাথে ত্রিপুরার সাব্রুমকে সংযুক্ত করতে ফেনী নদীর ওপর সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এ ছাড়া আখাউড়া থেকে আগরতলা পর্যন্ত রেলসংযোগ স্থাপন করা হচ্ছে। এতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রেলযোগে সরাসরি আগরতলায় পণ্যবাহী ট্রেন পৌঁছাতে পারবে। বাংলাদেশের বন্দর দু’টি ব্যবহার করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর জন্য পণ্য পরিবহন করলে ভারত অর্থ ও সময়Ñ দু’টিই বাঁচাতে পারবে।


আরো সংবাদ



premium cement