২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আল মাহমুদ আত্মবিশ্বাস ও বাঁক-বদল

-

মৃত্যু : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, জন্ম : ১১ জুলাই ১৯৩৬
১৯৬৮ সালে মাত্র দু’টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেই আল মাহমুদ বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। অনেকের মতো চেয়ে-চ্যাটে নয়। যোগ্যতার বলেই পুরস্কার অর্জন করেছেন। যোগ্যতার বলেই নিজস্ব আসন তৈরি করেছেন কাব্য-জগতে। তাই তিনি লিখতে পারেন ‘সবুজ ঈমান’ কবিতাটি। আত্মবিশ্বাসী কবি জানতেন লেখালেখিই যার জীবন, সে জীবন সুখের হয় না। এ কথা জেনেই কবিতার জগতে দৃঢ়তার সাথে পদচারণা করেছেন। কবিতা যেন কবির জীবন। সংসার কর্মযজ্ঞ থেকে নিজের ভিতর পালিয়ে বেঁচে ছিলেন। পোষাতে হয়েছে অনাত্মিয়তার দুঃস্বপ্নের ভেতরে। কারণ কবি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন পরজনমের উপর বিশ্বাসী থেকে তিনি অবশ্য অলৌকিক সাহসে বিশ্বাস রাখতেন।
আমি রবীন্দ্রনাথের পাশে রামকিংকরের চির দণ্ডায়মান
সুজাতার কাছে তাকে নিয়ে গিয়ে পায়েসান্ন
আমাদের দু’জনকে ভাগ করে দিতে বলতাম।
গৌতমের জন্য বয়ে আনা এই সুখাদ্য আর কার দাবি
রবীন্দ্রনাথ নেই, জীবনানন্দও নেই।

গর্বে নেচে বেড়াবার জন্য যখন একটা ফড়িংও
মাথার ওপর লাফিয়ে ওঠে, তখন
আমার আর দোষ কী?
[রবীন্দ্রনাথের বাড়ি, আরব্যরজনীর রাজহাঁস]

সাহিত্য জগৎ শুরু করেছিলেন গল্প দিয়ে। তখন মাত্র অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র অথচ খাতা ভরে ফেলছেন কবিতা লিখে। প্রভাব ফেলেছে কাজী নজরুল ইসলাম। বিশেষ করে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। আবার ম্যাক্সিম গোর্কির অনূদিত কিছু গল্প কবিকে অনুপ্রাণিত করে। ঝোঁকের মাথায় লিখে ফেলেন দু’টি গল্প। সৌভাগ্যই বলা যায়, গল্প দু’টি ছাপা হয় তৎকালীন কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সত্যযুগ’ পত্রিকায়। বেড়ে যায় কবির আত্মবিশ্বাস। গদ্য ও পদ্যোশক্তি কবিকে আগাম বার্তা জানিয়ে দেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় দারিদ্র্য কবিকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ১৯৫৪ সালে ঢাকায় চলে আসেন। গ্রাম্য সরলতায় ভরপুর কবির চার পাশটা শহুরে কবিদের হাস্যরসের উদ্রেক সৃষ্টি করলেও বৃদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় তিনটি কবিতা প্রকাশিত হলে আধুনিক বাংলা ভাষার কবি হিসেবে স্বীকৃতি এনে দেয়। হঠাৎ করেই যেন চিচিং ফাঁকের মতো কাব্যরহস্য জগতের দরজা খুলে যায় চিরদিনের জন্য। কবির কাব্যভাষার স্বাতন্ত্র্যতাই কবিকে বুঝতে সাহায্য করে। কবির ভাষা খুব সাধারণের ভাষা, যে ভাষা সাধারণ পাঠকদের বুঝতে সাহায্য করে। এটাই কবির সামাজিক যোগাযোগের ভাষা। তাই কবি উচ্চকণ্ঠে বলতেই পারেন ‘আমি পেরেছি’। কবি আজন্ম চেষ্টা করেছেন তাঁর ভাষার নিজস্বতাকে আরও গতিশীল ও অর্থবহ করার প্রক্রিয়াকে সচল করে রাখতে। এটাই কবির অহঙ্কার।
শতাব্দী সূর্যের শেষ অন্তগমন মুহূর্তের আমি এক নিরাসক্ত সাক্ষী।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আমি কৌতূহলহীন পরম দ্রষ্টাদের একজন।
আমি কবি।
কিন্তু কেবল সুন্দরের উপাসনায় কাটেনি আমার কাল।
কুশ্রীতা, রক্তপাত, মহামারী, ক্ষুধা ও জাতিহত্যার পাণ্ডুলিপি
আমি আজকের অস্তগমনের সাথে দরিয়ায় ডুবিয়ে দিতে
উপকূলের সবচেয়ে উঁচু পাথরে দণ্ডায়মান।
[শতাব্দীর সাক্ষী :১৪০০ সাল, আমি দূরগামী]

কৈশোরে প্রকৃতির মধ্যে নিজের তন্ময় মুগদ্ধতাকে আবিষ্কার করেই নিজের বাকি জীবনের শব্দতরঙ্গের মূর্ছনা সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিলেন কবি। কল্পনার স্বাধীনতা কবিকে দেখবার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে, কী কৈশোর কী যৌবনে। কবি যেন বৈশাখের বাতাসে উদ্দাম কেশরাশি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর প্রাত্যহিক জীবনের সঞ্চয়ে। পার্থিব লেনদেনের দাঁড়িপাল্লায় নিজেকে পরিমাপ না করে বরং শিল্প ও কর্মজজ্ঞের মধ্যে অদৃশ্য কিন্তু সুস্পষ্ট ভেদরেখো টেনে দিয়েছিলেন, এটাই কবির দৃঢ়তা, এটাই আত্¥বিশ্বাস। ‘কানকেঅলা মাছের ঝাঁক নদী-খাল-বিল ও পুকুরের স্বাভাবিক জীবন ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ার ব্যাকুলতায় মাটি ও বাঁধের ভেতরে রন্ধ্র খোঁজে।’(দিনযাপন পৃষ্ঠা ২২)। তেমনি কবি আত্মবিশ্বাসের রন্ধ্র ধরেই এতটা পথ পাড়ি দিয়েছেন। কম কোথায়; সেই ১৯৫৪তে শুরু শেষটা ২০১৯ এ। প্রায় ৬৫ বছর। কাল কাউকেই অব্যাহতি দেয় না, আর এই কালকেই স্কন্ধে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বহনের ক্ষমতা নিয়ে এতটা হেঁটেছেন কবি কাব্যজগতে।
লোকমুখে প্রচলিত কাহিনী এবং এর যে বিচ্যুতি থেকে উদ্ধার করে নৈতিক মূল্যবোধের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। গদ্য ছন্দকে যথার্থতা দিয়েছেন তার বেশ কিছু গদ্য কবিতায়।
যদিও অনেক কবি ছন্দেও দুর্বলতা ঢাকতে গিয়ে গদ্যছন্দে কবিতা রচনা করেন এবং অকপটে এই রীতিকে আধুনিক কবিতার আঙ্গিক বলে চালিয়ে দেয়ার প্রয়াস করেন। তারা ভুলে যান যে গদ্যেরও একটা বহমানতা বা ছন্দ আছে। আল মাহমুদের গদ্য কবিতার ভাষাশিল্পই বলে দেয় কবিতা কতখানি ছান্দিক। যেমন তাঁর ‘প্রহরান্তের পাশফেরা’ কাব্যে মধ্যযুগের উপাখ্যান নিয়ে লিখা কবিতা ‘জুলেখার আগুন’ ও ‘ইউসুফের উত্তর’।
‘লোক লোকান্তর’, ‘কালের কলস’ ও ‘সোনালী কাবিন’-এর পর আল মাহমুদের কাব্যভাষায় পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। এটা বাঁক না হলেও পরিবর্তন। সে পরিবর্তন আমরা দেখি ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ কাব্যগ্রন্থ থেকে। কবি বলেন, ‘মায়াবী পর্দার কবিতাগুলো লেখা হয়েছিল ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বসে।’ ১৯৭৪-১৯৭৫ সাল বইটির রচনাকাল। প্রকাশ হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। বরং বলা যায় সময় কবির মনের ভেতর পরিবর্তন এনে দেয় এবং কবির জীবনই একটি বাঁক অতিক্রম করতে গিয়ে বদলে যায়।
‘তাছাড়া একটি রেডিক্যাল পত্রিকা সম্পাদনার দায়ভাগ পোহাতে আমাকে জেলখানায় যেতে হয়। দৈবক্রমে জেলখানায় আমি আমার কবি জীবনের সার্থকতা নিয়ে ভেবে দেখার সুযোগ পাই। এবং সেমেটিক ধর্মগ্রন্থগুলোর ওপর একটি তুলনামূলক স্টাডি এবং গবেষণার সুযোগ পাই। যেহেতু বৌদ্ধ ও হিন্দু শাস্ত্রগুলো আগেই আমার মোটামুটি আয়ত্ত ছিল, সে কারণে পবিত্র কুরআন সহজেই আমার বোধগম্য হতে থাকে এবং সৌন্দর্যতত্ত্ব সম্পর্কে আমার ধারণাই পাল্টে যায়। এ সময় আমি ব্যাপকভাবে প্রাচীনকাব্য অধ্যয়ন শুরু করি। একই সাথে সেমেটিক, পারশিয়ান, হিন্দু এবং ল্যাটিন জগৎ আমার কাছে উন্মক্ত হতে থাকে। এভাবেই কাব্যের উত্তরাধিকার আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে’ [সাক্ষাৎকার, কিছুধ্বনি, নভেম্বর ১৯৯৩ ]।
একটি ঘটনা থেকে অন্য ঘটনায় কী করে বাঁক খায়, কবিতায় তার অজস্র প্রমাণ রয়েছে কবি আল মাহমুদের কবিতায়। জেলখানায় বসে কবির অর্জন হচ্ছে, নির্জনতা হাতড়িয়ে ওঁৎ পেতে থাকা সৌরভময় শব্দের অনুসন্ধান করা শব্দ শিকার করা এবং তিনি তা পূর্ণতাসহ সংগ্রহ করেছেন।
কবি যখন তাঁর ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ নামে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের কথা ভাবেন, তখন তাঁরই সমকালীন বন্ধু-কবি আপত্তি তোলেন এবং নামটি পাল্টে দেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেন। তার ধারণা ছিল কাব্যগ্রন্থের নামটির মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ শুঁকে বেড়াবে পাঠক। ইতিহাসও তাই বলে। আল মাহমুদের বিরোধী শিবিরের সবাই ভেবে থাকেন যে, বখতিয়ারের ঘোড়া একটি সাম্প্রদায়িক কবিতার বই। এ রূপ আমি ডজনখানেক জীবিত কবিদের চিনি যারা এখনো ভাবেন যে ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ একটি সাম্প্রদায়িক কবিতাগ্রন্থ। আমি এদের প্রায় সবাইকেই প্রশ্ন করে জেনেছি যে, এরা কেউই ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’র কোনো কবিতাই পড়েনি। অথচ সাম্প্রদায়িকতার সুর তুলে এক ধরনের প্রপাগাণ্ডা চালাচ্ছে, যা তাদের ঈর্ষা ও সঙ্কীর্ণ মানসিকতার পরিচয় বহন করে। এ রহস্যভেদ করা আমার কর্ম নয়, আমি জানি অনেকেই উত্তরাধিকারের কাছে ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’কে সাম্প্রদায়িকতার ছাপ মেরে প্রচার করে বেড়াচ্ছেন। বখতিয়ারের ঘোড়া, অতিরিক্ত চোখ দুটি, নারী, লেখার সময়, চেতনা বিন্দু, সনেট (১,২,৩,৪), রাত্রির গান, তোমার মাস্তুলে, ভারতবর্ষ, ডানাঅলা মানুষ, তোমার শপথে, যে ভালোবাসে না গান, মওলানা ভাসানীর স্মৃতি, সুন্দর নখ, খোলস ছাড়ার আগে, হত্যাকারীদের মানচিত্র-এর কথা তুললাম, কিছু কবিতা পড়েও শোনালাম, এদের কেউ দুঃখ প্রকাশ করল আগে না পড়ার জন্য। এভাবেই একজন প্রথাসিদ্ধ কবিকে হেয় করার পাঁয়তারাতে অনেকেই লিপ্ত ছিলেন শুধু প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে। অথচ কোনো নিষেধ মানেননি আল মাহমুদ শুধু তাঁর আত্মবিশ্বাসে তিনি অটল ছিলেন। অথচ একদল হিংসুটে পরশ্রীকাতর কবিই ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ নামটিকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়েছেন, এখনো চলছে সেই ব্যর্থ প্রচার।
‘তবে কি আমি আমার কাব্যগ্রন্থের নাম নির্ধারণে সত্যি কোনো সাম্প্রদায়িক বিষয়কে উত্থাপন করেছি? কই জীবনানন্দ দাশ যখন ‘কোথা যাও রায়রায়ান’ বলে পাঠকের জন্য প্রতীকের ব্যঞ্জনা দান করেন তখন কি আমরা এর মধ্যে কোনো সাম্প্রদায়িক ইচ্ছার প্রতিচ্ছবি খুঁজে বেড়াই? দারুণ দ্বিধার মধ্যে বইখানি বাজারে ছাড়া হয়।’
[আল মাহমুদ, দিনযাপন, পৃষ্ঠা ৫২]।
কান পাতো, এই মুহূর্তে আমার ভাষা বদলে যাচ্ছে
নর্থ বেঙ্গল ট্রেনের হুইসেল।
দিগন্ত বিস্তৃত আখখেতের মতো
আমাকে নিংড়ে নিচ্ছে মাড়াইয়ের কল।
আর আমার ভাষা রস হয়ে
গুড় হয়ে
চিনি হয়ে
ছড়িয়ে গেল কোটি কোটি প্রভাতের পেয়ালায়।
তোমার চকোলেট রঙের ঠোঁট থেকে উড়িয়ে দিও না
মৌমাছির ঝাঁক।
আল্লার কসম, আমার ভাষা এখন একলক্ষ রাণী মৌমাছির গুঞ্জন।
[তুমি আমার প্রথম উচ্চারণ, মিথ্যাবাদী রাখাল]

সব দ্বিধা অতিক্রান্ত করে আত্মবিশ্বাসী কবি যখন বখতিয়ারের ঘোড়া দাবড়িয়ে দিলেন, তখন কলকাতার আমিতাভ দাশগুপ্তের কাছে বইটি এতই গ্রহণযোগ্য হয় যে, তাঁর ‘পরিচয়’ পত্রিকায় রিভিয়্যু লিখবেন বলে কবিকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন এবং দে’জ প্রকাশনীর পক্ষ থেকে ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ সিরিজে আল মাহমুদের প্রতিশ্রুত পাণ্ডুলিপি পাঠানোর তাগিদ দেন ও বইটির খুঁটিনাটি দেখাশোনার দায়িত্ব নেন।
আসলে কোনো কোনো কবি বা লেখক এতটাই স্পর্শকাতর যে, তারা আমাদের ইতিহাস বা অস্তিত্বের মূলখুঁটি ও গৌরবকে লালন করতে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পায়। একসময় কানোজের ব্রাহ্মণ ও সেন বংশীয় রাজাদের শোষণ-পেষণে জর্জরিত এ দেশেরই ক্ষুদ্রজাতিগুলো ডেকে এনেছিল বখতিয়ারকে, রাজধানীর ফটক খুলে দিয়েছিল বাংলার অবহেলিত বীর কৈবর্তেরা অর্থাৎ জেলে সম্প্রদায়। এরূপ বহু ঐতিহাসিক ঘটনাবলি নিয়ে বাংলার কাব্যভাণ্ডার এখনো সমৃদ্ধ রয়েছে। আমাদের মনে রাখা দরকার যে, মানুষ বাসের সব অঞ্চলই কবিদের জন্য উন্মুক্ত। কবিকে এক অদৃশ্য ইঙ্গিত এসে অনুপ্রাণিত করে চলে গেলেও কবিতার সৃষ্টিতে সাহায্য করে।
হার্টফেল হলো মামুর। তার আতরের দোকান থেকে ফিরেই উবুর পড়লেন বিছানায়। চিকিৎসার আগেই স্পন্দনহীন পাথর। সংসার ভেঙে গেল। যেমন ভাঙে। ভাঙল আমার আশ্রয়। লান্ডিকোটালের মামী পানির দামে আতরের দোকানগুলো বিকিয়ে দিলেন। বাড়ি বিক্রির সময় রুদাকে চাইলাম। মামী হাসলেন, ‘সবুর বেটা। আপনা মুলুকসে ওয়াপাস আনে দো। রুদা তোমহারাই হোগী।’
আমার সবুরের মেওয়া মাকাল হয়ে ঝুলছে সারা বাঙলায়। দেখো, মানচিত্রে ফেটে রক্ত বেরুলো ইতিহাসের। উলু মারার ভয়ে যে বালক ঘরে বাতি জ্বালাত না সন্ধ্যায়, একাত্তরে হালাকু ঘোড়ার পিঠে চাবুক হেনেছে সে। তার জয়ধ্বনিতে এ দেশের মাটি ফুঁড়ে আকাশে মাথা তুলেছে স্বাধীনতার মিনার।
[ঘটনা, বখতিয়ারের ঘোড়া]

পাঁচ দশকের আর এক কবি ওমর আলী যখন গ্রাম থেকে শব্দরাজি কুড়িয়ে বসত গড়বেন ভাবছেন ততদিনে আল মাহমুদ গ্রাম কুড়ানো শব্দ দিয়ে মজবুত করে বসত-বাড়ি গড়ে তুলেছেন। এ দেশে কবি প্রতিভার জন্য নিরাপদ জীবিকা নেই। বাংলাদেশের কৃষিসমাজের পটভূমি থেকে উদ্গত হয়ে আধুনিক কবি হয়ে ওঠার জন্য জীবিকার নিরাপত্তাই একটি জটিল ধাঁধা হয়ে আটকে আছে। আর সে কবি যদি তাঁর কবিতায় ইসলামিক শব্দ চয়নের ধারাবাহিকতাকে প্রাধান্য দেন তবে তা আরও দুরূহ। একটি সাক্ষাৎকারে কলোনিয়াল সাহিত্য প্রসঙ্গে কবি বলেন,
‘আপনারা কি জানেন আমি কতটা নিশ্চিন্ত হয়ে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ দেশের সাহিত্যাঙ্গনে একাকী অসঙ্কোচে দাঁড়িয়ে আছি?’ সমকালীন ও সমগ্রকালীন অনেকের সাথে সাযুজ্য ও বৈপরীত্যের কথা তুললে কবি আরও বলেন, ‘ভবিষ্যতে একটা জিনিসের জন্য সাহিত্যের পাঠকগণ আমার প্রশংসা করবে। সেটা হলো এ দেশে যখন সাহিত্য শিল্পের জগতে ইসলামী আদর্শ ছিল খুবই নিন্দনীয় কাজ তখন আমি স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নিজেকে কবি হিসেবে সবার কাছে গ্রাহ্য করে তুলেছিলাম’ [জলঘড়ি, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি১৯৯৭ ]।

আমিই কবিই বটে। আমার আহার্য ভিন্ন, শাক-মাংস খাই
কোরোফিলে দাঁত মেজে খেয়ে ফেলি পৃথিবীর উত্থান-পতন।
গরু-বক্রী খাই বটে কিন্তু কোন মানুষ্য ধরিনি
কারণ নারীর গর্ভে আমারও যে জন্ম হয়েছিল।
জন্মের পরেই আমি মানুষের বাচ্চার মতোই
দারুণ চিৎকার করে কোনো এক সেমেটিক নারীর বুকের
রক্তিম দুধের বোঁটা নাগালের মধ্যেই পেয়ে যাই। তারপর কিছুকাল
‘আম্মা, আম্মা বলে এমন রোদন করি, কোলাহলে ঘুম ভেঙে গিয়ে
বাংলাদেশ আছাড়ি-পিছাড়ি খেয়ে বলে ফ্যালে-
হে পুত্র আমার।
[জীবনানন্দের প্রতি, আরব্যরজনীর রাজহাঁস]

কথার তাৎপর্য খুঁজতে খুব বেশি পরিবর্তিত আল মাহমুদকে খুঁজতে হয় না আমাদের। এ মাটিরই পুত্র আল মাহমুদ। একজন কবি। কবির সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। বাঙালি মুসলমানরা তা প্রথম উপলব্ধি করেন নজরুলের ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ বিরোধী দৃঢ় ভূমিকার মধ্যে। অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা যা পারেননি, তা পেরেছিলেন চির অসাম্প্রদায়িক কবি নজরুল। আর তাঁরই উত্তরাধিকার হলেন আল মাহমুদ। তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থই সোনালী কাবিন সে সাক্ষ্য দেয়-
‘বৃষ্টির দোহাই বিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই
দোহাই মাছ-মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর,
লাঙ্গল জোয়াল কাস্তে বায়ুভরা পালের দোহাই
হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোন কবি করে না কসুর।
কথার খেলাপ করে আমি যদি জবান নাপাক
কোনদিন করি তবে হয়ো তুমি বিদ্যুতের ফলা,
এ বক্ষ বিদীর্ণ করে নামে যেন তোমার তালাক
নাদানের রোজগারে না উঠিও আমিষের নলা।
[সোনালী কাবিন, ১৪]

‘বর্তমান সময়ে আমি বাংলা কবিতার সমকালীন ও আধুনিকতার নিরিখ। আমাকে বাদ দিয়ে এ যুগে বাংলা কবিতার যে কোনো সঙ্কলন বা সঙ্কলক স্বীকৃত হতে পারে না।’ আত্ম বিশ্বাসের কোন উঁচুতে অবস্থান করলে এমন কথাটি উচ্চারিত করা যায়। স্বপরিমাপ করার ক্ষমতা ক’জন রাখেন। না এটা কোনো পাগলের প্রলাপ নয় স্বয়ং কবি আল মাহমুদের জিহ্বায় উচ্চারিত শব্দমালা। যার প্রতিফলন খুঁজে পাই ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কাব্যগ্রন্থে।
অথচ ঘুমের মধ্যে কারা যেন, মানুষ না জিন
আমার কবিতা প’ড়ে ব’লে ওঠে, আমিন, আমিন।
[সবুজ ঈমান, বখতিয়ারের ঘোড়া]


আরো সংবাদ



premium cement