২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মনিরউদ্দীন ইউসুফ তাঁর সাহিত্যকর্ম

-

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে অনন্য প্রতিভাধর, কৃতী সাহিত্যব্যক্তিত্ব মনিরউদ্দীন ইউসুফ। তিনি একাধারে কবি, গজল রচয়িতা, গবেষক, প্রাবন্ধিক, উপন্যাসিক, শিশু সাহিত্যিক, ছড়াকার, নাট্যকার এবং সর্বোপরি প্রাজ্ঞ অনুবাদক। উপস্থাপনার নতুনত্ব ও আধুনিকতায় ঋদ্ধ তাঁর সাহিত্য সমৃদ্ধ কর্ম। শৈল্পিক সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ তাঁর সৃষ্টিকর্ম বহুল পঠিত ও পাঠক নন্দিত।
পারস্যের মহাকবি ফেরদৌসীর অমর মহাকাব্য ‘শাহনামা’র বঙ্গানুবাদ তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি। ইকবালের ‘কাব্য সঞ্চায়ন’, ‘দিওয়ানে-ই-গালিব’, ‘কালামে রাগিব’, ‘রুমীর মসনবী’ এসব দুরূহ সৃজন কর্মের স্বচ্ছ সাবলীল অনুবাদ করে তিনি বাংলা সাহিত্যে স্থির নক্ষত্র হিসেবে দেদৗপ্যমান।
শুধু অনুবাদ, কবিতা, গজল রচনা বা সাহিত্য সৃজনকর্মের মধ্যেই তাঁর সৃষ্টি সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি চলচ্চিত্রের কাহিনী, সংলাপ ও গীত রচনায়ও অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। ‘আলোমতি’, ‘তানসেন’, ‘তীর ভাঙ্গা ঢেউ’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য, সংলাপ রচনায়ও তাঁর সম্যক প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়।
এক কথায় মনিরউদ্দীন ইউসুফ একজন বড় মাপের প্রতিভাধর ও সৃজনশীল সাহিত্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর মৌলিক সাহিত্য ও সৃজনকর্মের মধ্যেও তিনি যেমন অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি অনুবাদ কর্মেও তাঁর অনন্য মেধা, মনন ও সৃজনশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। সেই সাথে তাঁর অনুবাদ কর্মে তাঁকে বাংলা সাহিত্যাকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
প্রতিভাধর এই কৃতি সাহিত্য ব্যক্তিত্ব ১৯১৯ খ্রি : ১৩ ফেব্রুয়ারি বৃহত্তর ময়মনসিংহের সবুজ ঐশ্বর্যে ঘেরা নদী নিসর্গ প্রকৃতির রূপ বৈচিত্রেপূর্ণ কিশোরগঞ্জ জেলাধীন তাড়াইল উপজেলার জাওয়ার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর সমকালীন ছিলেন তালীম হোসেন, ফররুখ আহমদ, জসিম উদ্দিন, সিকান্দর আবু জাফর, আহসান হাবীব, বেগম সুফিয়া কামাল প্রমুখ। সাহিত্যাঙ্গনে তিনি ছিলেন নিভৃতচারী, নিরহংকার ও প্রচারবিমুখ একজন গুণী ও মহৎ সাহিত্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিরবে নিভৃতে তাঁর সৃষ্ট কর্ম করে গেছেন কখনো তিনি নিজেকে প্রকাশে ব্যতিব্যস্ত ছিলেন না। তাঁর রচিত প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। এর মধ্যে রয়েছে কাব্য, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, জীবনী, কিশোর পাঠ্য, অনুবাদ ও আত্মজীবনী।
১৯৪১ খ্রি: মনিরউদ্দীন ইউসুফের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উপায়ন’ প্রকাশিত হয়। বলিয়াদি পাবলিশিং হাউজের পক্ষে মনিরউদ্দীন ইউসুফের মামা আব্দুল মতিন খান চৌধুরী ‘উপায়ন’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল বাইশ। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তাঁরই শিক্ষক সুসাহিত্যিক কাজী আব্দুল ওদুদকে প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘উপায়ন’ উৎসর্গ করেছিলেন। এ কাব্যগ্রন্থের মধ্য দিয়ে তিনি চিন্তা ও স্বকীয়তাকে তুলে ধরার প্রয়াস পান। সে সময়কার তাঁর চিন্তা চেতনা ‘উপায়ন’ এ পরিস্ফুটিত হয় এবং পাঠকদের কাছে বেশ সমাদৃত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন অধ্যাপক কবি মোহিতলাল মজুমদার উপায়নের কবিতার ভূয়সী প্রশংসা করেন।
তাঁর সবচেয়ে বড়, অসাধারণ ও অতুলনীয় কৃতির মধ্যে পারস্যের কবি আবুল কাসিম ফেরদৌসীর বিখ্যাত শাহনামার পূর্ণাঙ্গ বঙ্গানুবাদ। প্রাচীন পারসী সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ ‘শাহনামা’। মতান্তরে ষাট হাজার শ্লোকসংবলিত ‘শাহনামা’ মহাকাব্যটি বিশ্ব সাহিত্যে এক অসাধারণ ‘মহাকাব্য’। ফেরদৌসির এই শাহনামা মহাকাব্যটির স্বচ্ছ ও সাবলীল ছন্দ সৌন্দর্যে ঐশ্বর্যময় অনুবাদ করে মনিরউদ্দীন ইউসুফ অনন্য অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। সেই সাথে এক মহাকৃতি স্থাপন করেন। মহাকবি ফেরদৌসির এ শাহনামা গ্রন্থ রচনার সময় লেগেছিল সুদীর্ঘ ত্রিশ বছর আর মনিরউদ্দীন ইউসুফের তা অনুবাদ করতে সময় লাগে সুদীর্ঘ ১৮ বছর। মনিরউদ্দীন ইউসুফের শাহনামার বঙ্গানুবাদ গ্রন্থের পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল প্রায় ৬ হাজার। বাংলায় তিনিই প্রথম পূর্ণাঙ্গ আধুনিক স্বচ্ছ সাবলীল ছন্দ সৌকর্যে অনন্য ও মাধুর্যপূর্ণ ভাষায় শাহনামার অনুবাদ করেন। তাঁর অনুবাদটি ছিল গদ্যে, কিন্তু কাব্যিক মাধুর্য ও ছন্দ সৌন্দর্যেপূর্ণ ছিল।
মনিরউদ্দীন ইউসুফের সৃজনকর্মের উদ্দেশ্যই জাতি ও জনমানুষের কল্যাণ ও উন্নয়ন। একটি আদর্শ তার প্রত্যেক সৃজন কর্মে থাকে, যার মধ্যে মানবিকতাবোধ উচ্চকিত থাকে।
তাঁর উপন্যাস ঝড়ের রাতের শেষে (১৯৬২), পানসের কাঁটা (১৯৮১) ও ওর বয়স যখন এগারো (১৯৮৫) এই উপন্যাস এয়েও তিনি মানুষের আদর্শ চিন্তা চেতনা ও মানবিক মূল্যবোধকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন। গ্রামবাংলার হিন্দু ও মুসলিম পরিবারের পারস্পরিক সামাজিকতা ও সম্প্রীতি বন্ধন আদর্শ থেকে তিনি তাঁর পানসের কাঁটা উপন্যাসের বিষয় তুলে এনেছেন। বাঙালি মানস, বাঙালি প্রবাহ বিশেষ করে বাঙালিদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ঘটনা এ উপন্যাসের বিশদ বর্ণিত হয়েছে। যা ঐ সময়কে চিত্রিত করেছে। মানবিক প্রেমানুভূতি, দ্বন্দ্ব-দ্বিধা, মান অভিমান সব কিছু সুবিন্যস্তভাবে তিনি পাঠকের সম্মুখে উপস্থাপন করেছেন প্রামাণ্যচিত্রের মতো করে। তাঁর উপন্যাস কোথাও অসঙ্গতি নেই কিংবা অসংলগ্ন বর্ণনা নেই। তাঁর লেখার মধ্যে বিশেষ কারুকাজ ও সজীবতা লক্ষণীয়। যে অঙ্গে যে অলঙ্কার সুষমা মণ্ডিত হয় সে অলঙ্কার পরিয়ে উপন্যাসকে তিনি অধিকতর প্রাণবন্ত ও হৃদয়গ্রাহী করে তোলেন।
‘ওর বয়স যখন এগারো’ এ উপন্যাসটিতে আমাদের দেশ ও সামাজিক অবস্থার বর্ণনা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী চিত্রণ বলা যায় একে। আমাদের থেকে স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘটনা প্রবাহের দলিল হিসেবে এ উপন্যাসটি চিহ্নিত করা যায়। অত্যন্ত দক্ষ সৃজন প্রতিভায় তিনি তাঁর উপন্যাস মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়কে তুলে এনেছেন, যা শুধু সাহিত্য ব্যক্তিত্ব মনিরউদ্দীন ইউসুফের পক্ষেই সম্ভব। মনির উদ্দীন ইউসুফের উপন্যাসে দেশপ্রেম ও মানবিকতা উচ্চকিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী সময়কালের ঘটনাপ্রবাহ আবর্তিত হয়েছে ‘ওর বয়স যখন এগারো’ উপন্যাসে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়, অস্থিরতা এ উপন্যাসে এসেছে বাস্তবতার নিরিখে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কাহিনী চিত্রণে মনির উদ্দীন ইউসুফ একজন সফল কৃতী সৃজনী ব্যক্তিত্ব, এ কারণে সশ্রদ্ধচিত্তে তিনি সবসময়ই স্মরিত হবেন।
অনৈতিকতা ও অপসংস্কৃতি পরিত্যাগ করে সুস্থ সমাজ মানস গড়ার প্রয়াস, অহঙ্কারকে পদদলিত করে বিবেক মানবিকতাকে জাগ্রত করার উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা এই সঙ্গে বিবেককে মানবতার কল্যাণে সমর্পণের প্রয়াস তার উপন্যাসে রয়েছে।
শ্রদ্ধেয় অনন্য সৃজনী প্রতিভাধর একজন উপন্যাসিক মনিরউদ্দীন ইউসুফ, যিনি সবসময় পাঠকের হৃদয়ের আসনে সসম্মানে থাকবেন।
বাংলা সাহিত্যে তাঁর উপন্যাস শিল্প সৌকর্যে অনন্য ও আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়ে চিহ্নিত থাকবে। সবসময় দেশ, সমাজ, পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে তিনি ভাবতেন। তাঁর সৃজন কর্মে তারই প্রতিফলন দেখা যায়। তাঁর কবিতা, তাঁর উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক কিংবা অনুবাদ সব কিছুতেই তাঁর সমাজ সচেতনতার প্রচ্ছন্ন প্রতিফলন দেখা যায়।
তাঁর একটি নাটক ‘ঈসা খাঁ’। ঐতিহাসিক এ নাটিকা অত্যন্ত জনপ্রিয়। ১৯৬৮ সালে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ঈসা খাঁ’র জীবন কাহিনী অবলম্বনে লেখা এ ঐতিহাসিক নাটকে ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরা হয়েছে। এ নাটকের মধ্য দিয়ে মনিরউদ্দীন ইউসুফের বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় মেলে।
তাঁর বেশ কটি প্রবন্ধ গ্রন্থ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখ্য ‘নব পরিচয়ে রবীন্দ্রনাথ’, ‘আত্মপরিচয় ঐতিহ্যের আলোকে’, ‘বাংলাদেশের সার্বিক অগ্রগতির লক্ষ্যে একটি প্রস্তাব’। তাঁর প্রবন্ধের ভাষা অত্যন্ত সাবলীল, সহজ বোধগম্য, দেশ, সমাজ, সাহিত্য সবই তাঁর প্রবন্ধের বিষয়বস্তু। তাঁর প্রবন্ধ সাহিত্যেও তাঁর অনন্য কৃতিত্ব স্পষ্ট।
১৯৮৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি এই কৃতী সাহিত্য ব্যক্তিত্ব এ পৃথিবী ছেড়ে আপন ঠিকানায় ফিরে যান কিন্তু তিনি সুচিন্তিত মননশীল প্রবন্ধ, জীবন চরিত, কবিতা, উপন্যাস, নাটিকা সেই সাথে চিরায়ত সাহিত্যের অনুবাদ কর্মে অসাধারণ নৈপুণ্য ও কৌশল সৌকর্য গুণে অনন্য ও অসাধারণ সৃজনী ব্যক্তিত্ব হিসেবে বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে থাকবেন। হৃদয়ের গভীর থেকে তাঁর জন্য গভীর শ্রদ্ধা রইল।


আরো সংবাদ



premium cement